ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ বিডি ডট কম,নিজস্ব প্রতিনিধি,১৯ জুন : নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন শিক্ষা কর্মকর্তারা। এদের বেশির ভাগই বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের সদস্য। ঘুষ, দুর্নীতি, দাপ্তরিক অনিয়ম ও কর্মক্ষেত্রে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া এ কর্মকর্তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। দু’একটি ক্ষেত্রে তদন্ত হলেও প্রতিবেদন অনুসারে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কয়েকজনকে বদলি করা হয়েছে। তবু থেমে নেই অপকর্ম।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) ছাড়াও প্রেষণে শিক্ষা খাতের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প, দেশের ১০টি শিক্ষা বোর্ড, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি), পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ), জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম), মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর, মাদ্রাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে এসব কর্মকর্তারা কাজ করছেন।
বেপরোয়া ঘুষ বাণিজ্য :শিক্ষা ক্যাডারের অন্যতম কর্মকর্তা ও প্রভাষক (দর্শন) মো. মোস্তাফিজুর রহমান। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ডিআইএর সহকারী শিক্ষা পরিদর্শক হিসেবে কাজ করছেন তিনি। গত ৩০ মে ঘুষের দুই লাখ টাকাসহ তাকে রাজধানীর নয়াপল্টন এলাকা থেকে গ্রেফতার করে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি টিম। পরে তার দেহ তল্লাশি করে আরও ৯৮ হাজার টাকা জব্দ করা হয়। মন্ত্রণালয় তাকে গত ৪ জুন সাময়িক বরখাস্ত করেছে।
পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলার পঞ্চগ্রাম সম্মিলনী মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরিদর্শনের সময় প্রতিষ্ঠানের পক্ষে প্রতিবেদন দেওয়ার আশ্বাসে মোস্তাফিজুর তিন লাখ টাকা দাবি করেন। প্রথম দফায় দুই লাখ টাকা নেওয়ার সময়েই দুদক টিম তাকে হাতেনাতে গ্রেফতার করে। পরে আদালত তাকে জেলহাজতে পাঠান।
ডিআইএর ক্ষমতাধর এই কর্মকর্তা একই প্রতিষ্ঠানের উপ-পরিচালক (ঢাকা বিভাগ) মো. রাশেদুজ্জামানের ঘনিষ্ঠজন। কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিবিরের দুর্ধর্ষ ক্যাডার রাশেদুজ্জামান একজন সাবেক এপিএসের আশীর্বাদে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা ভবনে অবস্থান করছেন। বর্তমান সরকারের আমলে দুর্নীতির দায়ে তাকে ১৩ মাস ওএসডি থাকতে হয়। ২০০৯ সালে তাকে মাউশির পরিকল্পনা শাখার সহকারী পরিচালক পদে পদায়ন করা হয়। কাজে যোগ দিয়েই তিনি মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের কাছ থেকে বদলির বিনিময়ে ঘুষ কালচার শুরু করেন। একপর্যায়ে তিনি মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে গঠিত ‘সেকায়েপ’ প্রকল্পের ক্রয় কমিটির সদস্য হন। সেকায়েপ সংশ্লিষ্টরা জানান, রাশেদুজ্জামান এই প্রকল্পে শুধু ফটোকপি করার নামেই ভুয়া বিল-ভাউচার জমা দিয়ে দুই কোটি টাকা নিয়েছেন। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত এ প্রকল্পের কেনাকাটায় কোটি কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগও রয়েছে। এ নিয়ে তদন্ত করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চাপ দেয় বিশ্বব্যাংক।
২০১০ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক যুগ্ম সচিব (কারিগরি) এম মোজাম্মেল হকের নেতৃত্বে তদন্ত শুরু হয়। তদন্তে প্রকল্পের ১২ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। একই বছরের নভেম্বরে জমা দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে মূল অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয় রাশেদুজ্জামান ও প্রকল্প পরিচালক যুগ্ম সচিব বদিউল ইসলামকে। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকল্প পরিচালকসহ সবাই হন ওএসডি। রাশেদুজ্জামানের বিরুদ্ধে দেওয়া হয় বিভাগীয় মামলাও। তবে অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে এক বছরের মাথায় পদোন্নতি পেয়ে উপ-পরিচালক হন তিনি। সমকালের সঙ্গে আলাপকালে অবশ্য রাশেদুজ্জামান ছাত্রশিবির করার কথা অস্বীকার করেন। সেকায়েপ প্রকল্পের দুর্নীতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ক্রয় কমিটিতে আমি মাত্র ১২ জনের একজন ছিলাম। মাউশির প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে ছিলাম। দোষী হলে তো আমার শাস্তিই হতো।’
অন্যদিকে, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে ঘুষের রাজত্ব কায়েম করেছেন কলেজ পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের সহযোগী অধ্যাপক (অর্থনীতি) ড. আশফাকুস সালেহীন। অভিযোগ, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে কলেজ পরিদর্শকের কার্যালয়ে লাখ লাখ টাকার দুর্নীতি হয়ে থাকে। উত্তরা হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে একটি গ্রুপের কাছ থেকে আশফাকুস সালেহীন পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ নেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের নজরে আনলেও এখনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। দুদকের পরিচালক মীর জয়নুল আবেদীন শিবলীর নেতৃত্বাধীন একটি টিম বর্তমানে উত্তরা স্কুলে সংঘটিত এসব অনিয়মের তদন্ত করছে। সমকালের সঙ্গে আলাপকালে আশফাকুস সালেহীন উত্তরা হাইস্কুল থেকে ঘুষ নেওয়ার কথা অস্বীকার করলেও এ বিষয়ে একাধিক তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের এই কর্মকর্তাসহ আরও দুই কর্মকর্তা সম্প্রতি দুর্নীতির টাকায় দুটি মাইক্রোবাস কিনে খোদ বোর্ডের কাছেই আবার ভাড়া দিয়েছেন বলে জানা গেছে। এসব ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. মাহবুবুর রহমান সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে সমকালকে বলেন, ‘আমার দৃষ্টিতে কোনো ঘটনা ধরা পড়লে আমি সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিই। বোর্ডে সেবা নিতে আসা কারও কাছে কেউ টাকা-পয়সা চাইলে বা কোনো দপ্তরে কেউ হয়রানি করলে আমাকে সঙ্গে সঙ্গে জানাবেন।’
পাঠ্যপুস্তক বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, নিজ কার্যালয়ে বসে আপত্তিকর পানীয় পানের অভিযোগে সম্প্রতি বোর্ডের শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী শিক্ষা ক্যাডারের সহযোগী অধ্যাপককে উত্তরাঞ্চলের দূরবর্তী একটি জেলার কলেজে বদলি করা হয়েছে। এ ঘটনা জানতে পেরে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন বলে জানা গেছে।
শিক্ষা ভবন হিসেবে পরিচিত মাউশিতেও বেশ কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। বেসরকারি কলেজ শাখার একজন উপ-পরিচালক পাঁচ হাজার টাকা ছাড়া কোনো ফাইলে সই করেন না। সারাদেশ থেকে আসা বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের ব্যাপক হয়রানিও করেন তিনি। এই শাখার পরিচালকের বিরুদ্ধে রয়েছে নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ। মাউশির অপর গুরুত্বপূর্ণ একটি শাখার পরিচালকের বিরুদ্ধে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের জানাজায় অংশ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। যদিও তিনি বহাল তবিয়তেই আছেন। নিজের সন্তানের বন্ধুর আইটি ফার্ম থেকে মাউশির বিপুল অঙ্কের দ্রব্যসামগ্রী অনিয়ম করে কেনার অভিযোগ উঠলেও এই পরিচালক তা ধামাচাপা দিয়েছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ একজন আমলার নাম ভাঙিয়ে মাউশির পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন, উপ-পরিচালক জাহাঙ্গীর হোসেন ও পরিচালক (অর্থ ও ক্রয়) ড. মোহাম্মদ মোজাম্মেল হোসেন চৌধুরী শিক্ষা ভবনে ‘নোয়াখালী’ সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন বলে জানিয়েছেন এ প্রতিষ্ঠানের একাধিক কর্মকর্তা।
নারী সহকর্মীর সঙ্গে অসদাচরণ: শক্তিশালী এই নোয়াখালী সিন্ডিকেটের সদস্য মাউশির সহকারী প্রকৌশলী আবু তাহের চৌধুরী গত ১৪ মে মাউশির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখার গবেষণা কর্মকর্তা কামরুন্নাহারকে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করেন। অফিস ছুটি শেষে বাসায় যাওয়ার সময় কামরুন্নাহারের গাড়িতে উঠতে দেরি হওয়ায় ক্ষিপ্ত আবু তাহের চৌধুরী তাকে গালাগালি করেন। এ ঘটনার পর শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশে ২৩ মে আবু তাহের চৌধুরীকে বরগুনা জেলা অফিসে সংযুক্ত করে বদলির আদেশ জারি করা হয়।
মাউশির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখার উপ-পরিচালক জাহাঙ্গীর হোসেনের বিরুদ্ধেও নারী সহকর্মীদের সঙ্গে অশালীন ও অসদাচরণের অভিযোগ করেছেন ওই শাখার একাধিক নারী কর্মকর্তা। ওই শাখার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নারী সহকারী পরিচালক সমকালকে বলেন, ‘ডিডি জাহাঙ্গীর সবসময়ই নারী সহকর্মীদের সঙ্গে আনঅফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করে কথা বলেন। নানা কুৎসিত ইঙ্গিত করেন। এ ছাড়া তিনি পরিকল্পনা শাখার কাজকর্ম সম্পর্কেও ভালো বোঝেন না। বিষয়টি আমরা মহাপরিচালককে জানিয়েছি।’
জালিয়াতি: জালিয়াতি করে ছয়জন বেসরকারি কলেজ শিক্ষককে এমপিওভুক্ত করার দায়ে মাউশির ঢাকা অঞ্চলের উপ-পরিচালক গৌরচন্দ্র মণ্ডলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব নুসরাত জাবীন বানু স্বাক্ষরিত এই আদেশের প্রতিপালন এখনও করেনি মাউশি। এই ছয় প্রভাষক হলেন_ গোপালগঞ্জ মুকসুদপুর বঙ্গরত্ন ডিগ্রি কলেজের অজিত কুমার মণ্ডল ও কোটালীপাড়া নেছার উদ্দিন কলেজের নিমচাঁদ হাওলাদার, নেত্রকোনা পূর্বধলা ডিগ্রি কলেজের জাফরিন সুলতানা ও পূর্বধলা হাফেজ জিয়াউর রহমান কলেজের নাদিরুজ্জামান, সাতক্ষীরা তালার পাটকেলঘাটা এইচ আর কলেজের পলাশ ঘোষ এবং নোয়াখালী সুধারামের চরমটুয়া কলেজের মাজেদুল ইসলাম। দাপ্তরিক ভুলের নামে এই অপকর্মের দায় এড়ানোর চেষ্টা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
শিক্ষা কর্মকর্তাদের এ ধরনের অপকর্ম সম্পর্কে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সভাপতি ও রাজধানীর কবি নজরুল সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ আই কে সেলিমউল্লাহ খন্দকার সমকালকে বলেন, ‘কারও কোনো ব্যক্তিগত অপরাধের দায় সমিতি নেয় না। নেবেও না। সরকারি কর্মকর্তাদের সরকারি চাকরিবিধি, শৃঙ্খলা-আপিল-১৯৮৫ মেনে চলতে হয়। এর ব্যত্যয় ঘটালে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা উচিত।’ তিনি বলেন, ‘শিক্ষা ক্যাডারে অনেক ভালো, দক্ষ ও সৎ কর্মকর্তা আছেন। তাদের যথাযথ জায়গায় বসালে দুর্নীতি কমে আসবে।’
শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য: শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সমকালকে বলেন, ‘দুর্নীতি করলে কাউকে রেহাই দেওয়া হবে না। অপকর্ম করে কেউ পার পাবে না। আমরা খুবই কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছি।’ ডিআইএ কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমানের উদাহরণ তুলে তিনি বলেন, ‘অভিযোগটি আমাদের কাছেই প্রথম এসেছিল। আমরাই দুদককে জানিয়েছি এবং তাদের সহযোগিতা করেছি, যেন তারা হাতেনাতে ঘটনাটি ধরতে পারেন। এই ধরনের নানা ব্যবস্থা নিচ্ছি। শিক্ষা খাতে দুর্নীতি কমাতে আপ্রাণ চেষ্টা করছি। আগের চেয়ে তা কমেও এসেছে।’ মন্ত্রী বলেন, ‘সমাজে দুর্নীতি আছে এবং শিক্ষা খাতও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। দুর্নীতি দূর করতে সবার সহযোগিতা চাই।’
সৌজন্যে : দৈনিক সমকাল।