চাঁদা দেওয়াই ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের নিয়তি

SHARE

020057Insert_kalerkantho_picওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ বিডি ডট কম,নিজস্ব প্রতিনিধি,১৮ জুন : রুহুল আমিনের বাড়ি চট্টগ্রামে। এইচএসসি পাস করে বছর দেড়েক আগে ঢাকায় আসেন একটি চাকরি জুটিয়ে সংসারের হাল ধরতে।

বাড়িতে রয়েছে স্ত্রী ও এক সন্তান। অনেক চেষ্টা করেও চাকরি মেলেনি। এরপর রামপুরায় হকারের কাজ শুরু করেন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে দিনে এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকার শার্ট বিক্রি করতে পারেন; ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা লাভ হয়। কিন্তু রোজ পুলিশ ও মাস্তানদের চাঁদা দিতে হয়।

মাস্তানদের কাছ থেকে কখনো বা রেয়াত মিললেও পুলিশের কাছ থেকে এক দিনও রেয়াত মেলে না। রুহুল আমিন বলেন, দোকান নিয়ে বসলেই চাঁদা গুনতে হয় দুই শ টাকা। পুলিশের এক লাইনম্যান সেই টাকা ওঠায়।

বিমানবন্দর থানার আশকোনায় হাজি ক্যাম্পের সামনে এক বছর ধরে ব্যবসা করছেন জুলফিকার আলী। তিনি জানান, প্রতিদিন পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের চাঁদা দিতে হয়। ঈদের জন্য চাঁদার রেট বেড়ে গেছে।

আশকোনা থেকে কুড়িল হয়ে রামপুরা পর্যন্ত অন্তত দেড় হাজার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ফুটপাতে দোকান চালায়। তাদের কাছ থেকে প্রতিদিন প্রায় চার লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর ফুটপাতে তিন শতাধিক লাইনম্যান চাঁদা আদায় করে। ফুচকাওয়ালা, আইসক্রিমওয়ালাও চাঁদা থেকে বাদ যায় না। সিটি করপোরেশনের ১৬৩ কিলোমিটার ফুটপাতে দোকানের সংখ্যা আড়াই লাখের বেশি। দোকানপ্রতি গড়ে ১৫০ টাকা হিসাবে প্রতিদিন চাঁদা ওঠে তিন কোটি ৭৫ লাখ টাকা। রোজার সময় হকারের সংখ্যা বাড়ে, বাড়ে চাঁদার হারও।

হকার নেতারা জানান, রোজার সময় দিনে অন্তত পাঁচ কোটি টাকার চাঁদা ওঠে ফুটপাত থেকে। এর সিংহভাগ পায় পুলিশ। চাঁদা দিতে হয় রাজনৈতিক নেতা ও মাস্তানদের। বাদ যান না সিটি করপোরেশনের কর্মীরাও। মার্কেটের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও চাঁদা আদায় করা হয়। সংশ্লিষ্ট থানার ওসি থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যন্ত সবাই চাঁদার ভাগ পায়। ফলে পুলিশের কাছে অভিযোগ করে প্রতিকার পাওয়া যায় না।

ঢাকার ফুটপাতের ব্যবসা সম্পর্কে সরেজমিন অনুসন্ধান করতে গিয়ে এসব তথ্য মিলেছে। শুধু চাঁদাবাজিই নয়, কোনো কোনো এলাকার ফুটপাতের দোকানের পজেশনও বিক্রি হয়।

এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘রোজা ও ঈদকে সামনে রেখে কোথাও চাঁদাবাজি হচ্ছে কি না তার খোঁজ রাখবে গোয়েন্দারা। কাউকে চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, ‘চাঁদাবাজি রুখতে পুলিশ কাজ করছে। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার চাঁদাবাজির ঘটনা তেমন নেই। তার পরও আমরা বেশ সতর্ক আছি। ’ তিনি বলেন, পুুলিশের কেউ চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সাত বছর ধরে গুলিস্তান ও জিপিও এলাকার ফুটপাতের লাইনম্যান হিসেবে কাজ করেন হকার লাল মিয়া। গত মঙ্গলবার পল্টন মোড়ে তাঁর সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন সময় বেঁধে দেওয়ায় আগের চেয়ে চাঁদাবাজি কিছু কমেছে।

লাল মিয়া বলেন, ‘পুলিশ ও  স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের নামে চাঁদা উঠাই। এক হাজার টাকা তুললে আমাকে দেওয়া হয় ২০০ টাকা। বাকি আট শর মধ্যে পুলিশ নেয় ৫০০, নেতারা পান ৩০০ টাকা। ’ তিনি জানান, ‘একসময় আমিও গুলিস্তানে কাপড়ের ব্যবসা করেছি। পুলিশ ও নেতাদের চাঁদা দিয়েছি। এক দিন চাঁদা না দেওয়ায় এক নেতা আমাকে থাপ্পড় মেরেছিল। এরপর প্রতিজ্ঞা করে চাঁদাবাজিতে নেমে পড়ি। পরে ওই নেতাকে শায়েস্তা করে এলাকাছাড়া করি। ’

লাল মিয়া বলেন, বড় দোকান থেকে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা চাঁদা তোলা হয়। ছোট দোকান থেকে নেওয়া হয় ১০০ থেকে ২০০ টাকা। ৫০ টাকাও ওঠানো হয়। রমজানে চাঁদার রেট বেড়ে যায়। প্রতিদিন রাতের বেলায় থানার ক্যাশিয়ার এসে তাঁদের ভাগের টাকা নিয়ে যান। আর থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদের টাকা পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তবে কোনো নেতার নাম জানাতে অনিহা প্রকাশ করেন তিনি।

নাম প্রকাশ না করে এক হকার-নেতা বলেন, সরকার অবৈধ এই চাঁদাবাজি বন্ধ করে হকারদের কাছ থেকে ‘ফুটপাতের খাজনা’ আদায় করতে পারে।

ফুটপাতে পুলিশের চাঁদাবাজি সম্পর্কে মন্তব্য জানতে চাইলে ডিএমপির রমনা বিভাগের উপকমিশনার মারুফ হোসেন সরদার বলেন, ‘লাইনম্যানের বিষয়ে আমার জানা নেই। যদি কেউ সুনির্দিষ্টভাবে চাঁদাবাজির তথ্য দিতে পারে তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’

হকাররা জানায়, পুলিশের কাছে চাঁদাবাজির কোনো অভিযোগ নিয়ে গেলে তারা কোনো সহযোগিতা করে না। কারণ তারা নিজেরাই এর সঙ্গে জড়িত।

রাজধানীতে পুলিশের পক্ষে ফুটপাত থেকে চাঁদা তোলে তিন শর বেশি লাইনম্যান। ফার্মগেট, গুলিস্তান, ফুলবাড়িয়া, নিউ মার্কেট, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা কলেজ, কলাবাগান, গ্রিন রোড, মিরপুর, পল্লবী, কাপ্তান বাজার, সদরঘাট, মহাখালী, উত্তরা, দক্ষিণখান, মালিবাগ, মগবাজার, যাত্রাবাড়ী প্রভৃতি এলাকা ঘুরে হকার এবং লাইনম্যানদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।

আশকোনার হকার মোসাদ্দেক জানান, কিছুদিন আগেও ২০০ টাকা করে চাঁদা দিতেন তাঁরা। রোজা ও ঈদ উপলক্ষে চাঁদার পরিমাণ ১০০ টাকা বেড়ে গেছে।

রোজা ও ঈদ উপলক্ষে রাজধানীতে পণ্যবাহী ট্রাকের আনাগোনা বেড়েছে। পুলিশও চাঁদার হার বাড়িয়ে দিয়েছে। কুষ্টিয়া থেকে কারওয়ান বাজারে ফুলকপি নিয়ে আসেন শরিফ উদ্দিন। তিনি জানান, ঢাকা পর্যন্ত একটি পিকআপের ভাড়া ১০ হাজার টাকা। পুলিশকে চাঁদা দিতে হয় তিন হাজার টাকা। ফলে গাড়িপ্রতি ১৩ হাজার টাকা খরচ পড়ে।

এক ট্রাকমালিক কালের কণ্ঠকে বলেন, পুলিশের দায়িত্ব চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু তা না করে তারা তাদের সহায়তা করে। তাদের কাছ থেকে হয়তো পুলিশ চাঁদার ভাগ পায়। তারা ট্রাকচালককে যতটা নাজেহাল করে ততটা চাঁদাবাজকে করে না। ’ তিনি বলেন, ‘রমজানে সব কিছুর বেচাকেনা বাড়ে। মফস্বল থেকে প্রচুর মাল ঢাকায় আসে। এ সুযোগে পুলিশ ও চাঁদাবাজরা চাঁদার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। ’

জাতীয় হকার্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা সব সময় বলে আসছি, চাঁদাবাজি বন্ধ করে সরকার হকারদের কাছ থেকে খাজনা নিতে পারে। আমরা প্রতিবছর সরকারকে ৮০০ কোটি টাকা রাজস্ব দিতে পারব। ভারত সরকার হকারদের স্বীকৃতি দিয়েছে। আমরাও স্বীকৃতি চাই। ’

রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকা গুলিস্তানে এখন সন্ধ্যার আগে হকারদের বসতে দেওয়া হচ্ছে না। সন্ধ্যার পর বসে ব্যবসা খুব একটা হয় না। তবে বিক্রি না হলেও পুলিশ ও নেতাদের চাঁদা উঠছে ঠিকই। অন্যান্যবার ঈদের আগে আগে চাঁদা বেড়েছে। এবার রোজা শুরুর আগেই পুলিশের রেট বাড়তে শুরু করে। এবার সিটি করপোরেশনের কিছু কর্মীও চাঁদাবাজিতে নেমেছে বলে জানা গেছে।

কয়েকজন হকার জানিয়েছেন, শার্ট-প্যান্টের ছোট দোকানের জন্য প্রতিদিন ১০০ টাকা, একটু বড় দোকানের জন্য ১৫০ টাকা এবং জুতার দোকানের জন্য ২০০ থেকে ২৫০ টাকা চাঁদা দিতে হয়।

অনুসন্ধানের সময় দেখা গেছে, রাজধানীর অন্যান্য স্থানে ঝামেলা কম হলেও গুলিস্তান, পল্টন ও মতিঝিলের হকাররা বেশ বেকায়দায় রয়েছে। গুলিস্তানের এক হকার বলেন, ‘যানজটমুক্ত করতে আমাদের উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে রাস্তা থেকে। অফিস ডেতে সন্ধ্যার পর বসতে দেওয়া হয়। ওই সময় খুব একটা বেচাকেনা হয় না। তবে পুলিশকে চাঁদা ঠিকই দিতে হয়। না দিলে পরদিন জায়গা পাওয়া যায় না।

বিমানবন্দর গোলচত্বর থেকে আশকোনার হাজি ক্যাম্পের ফুটপাত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দখলে। সেখানে সরকারি জায়গার পজিশনও বিক্রি করা হয়।

আশকোনা এলাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাও রাস্তা দখল করে রাখে। অটোগুলো থেকেও নিয়মিত চাঁদা আদায় করা হয়। চালকরা সেটা পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে যাত্রীর ঘাড়ে চেপে। উত্তরার জসিম উদ্দিন রোড থেকে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত ফুটপাত এবং সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা অটোরিকশা থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করা হয়। পুলিশ দেখেও দেখে না। এসব স্থান থেকে প্রতিদিন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অন্তত পাঁচ লাখ টাকার চাঁদা আদায় করেন।

উত্তরার মাসকট প্লাজা ও নর্থ টাওয়ারের সামনের ফুটপাতে শাসক দলের কিছু নেতা মিনি মার্কেট বসিয়েছে। এটির দেখাশোনা করেন যুবলীগ নেতা কবির হোসেন ওরফে বরিশাইল্যা কবির ও তাঁর ভাগিনা আলম এবং গফুর, সেলিম, খোকন, কায়েস, মিন্টু, ফেরদৌস, কায়েস, বাবু, জসীম ও হেলাল। নেতৃত্বে রয়েছেন খোকন, কায়েস, বাবু ও সেলিম। সেখানে রয়েছে শতাধিক জামাকাপড়ের দোকান।

আব্দুল্লাহপুরের পুব পাশের বেড়িবাঁধের রাস্তার দুই পাশেই অটো ও লেগুনার দীর্ঘ লাইন। গাজীপুরের কালীগঞ্জে দ্রুত যাওয়ার পথ এটি; উত্তরখান-দক্ষিণখান যাওয়ার অন্যতম সড়ক। দুই পাশেই অটো-লেগুনার দীর্ঘ লাইনের কারণে যানজট লেগেই থাকে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক লাইনম্যান জানান, ‘এ রোডে ৪৫০টি অটো চলাচল করে। প্রতিটি অটো থেকে দৈনিক ১০০ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। চাঁদাবাজরা ‘জিপি’ বললেই আমরা টাকা দিয়ে দিই। ’

চাঁদা আদায় করেন শাসকদলের নেতারা। হাউজ বিল্ডিংয়ে চাঁদা আদায় করেন কাউসার ও দিয়াবাড়ী এলাকায় সেলিম। হাউজ বিল্ডিংয়ে প্রতিটি লেগুনা থেকে ২০০ টাকা ও দিয়াবাড়ীতে ১২০ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। আজমপুরের পুব পাশের ইজিবাইক স্ট্যান্ডে চাঁদাবাজির নেতৃত্বে রয়েছেন ছাত্রলীগ নেতা মোশারফ হোসেন। সেখানে ৫০০ ইজিবাইক দাঁড়ায়। গাড়িপ্রতি দৈনিক ১৫০ টাকা আদায় করেন লাইনম্যান রানা ও ছোট বিকাশসহ অন্তত ১০ জন।

বিমানবন্দর পুলিশ বক্স ও ট্রাফিক বক্স আলাদাভাবে প্রতিদিন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে। শ্রমিক লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও চাঁদা আদায় করে। পুলিশ বক্সের জন্য চাঁদা তোলেন বাবলু। তিনি শ্রমিক লীগের কর্মী পরিচয় দেন। মাছের দোকান থেকে চাঁদা তোলেন আলম। প্রতিটি দোকান থেকে এক হাজার ২০০ টাকা আদায় করা হয়।

জিআরপি পুলিশের পক্ষে চাঁদা আদায় করেন আকতার হোসেন। জামাল নামের পুলিশের এক সোর্স টাকা তোলেন ট্রাফিক বক্স ও সার্জেন্ট বক্সের জন্য। মনির টাকা তোলেন রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশের জন্য।

সৌজন্যে : দৈনিক কালের কন্ঠ।