ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ বিডি ডট কম,সৌরভ হাবিব রাজশাহী ব্যুরো,০৬ জুন : লাইসেন্স নেই, সর্বনিম্ন দরদাতাও নয়। তারপরও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের বৈদ্যুতিক কাজের প্রায় দুই কোটি টাকার তিনটি টেন্ডার পেয়েছে ‘এসএলকে ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড’। টেন্ডার পাওয়ার জন্য ‘বৈদ্যুতিক ঠিকাদারি লাইসেন্স’ বা এবিসি লাইসেন্স বাধ্যতামূলক হলেও ওই প্রতিষ্ঠানটির তা নেই। কাজের ক্ষেত্রেও নিম্নমানের মালপত্র ব্যবহারের প্রমাণ মিলেছে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) টেস্টে। এরপরও পৌনে তিন কোটি টাকার আরেকটি কাজ এ প্রতিষ্ঠানটিকে দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে। অভিযোগ রয়েছে, সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী রেজায়াত হোসেন রিটুর সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে বারবার প্রতিষ্ঠানটি টেন্ডার পাচ্ছে।
জানা গেছে, এসএলকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পাওয়া সব দরপত্রের ক্ষেত্রে রাসিকের দায়িত্বশীল নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন রেয়াজাত হোসেন রিটু। যন্ত্রকৌশল বিভাগ থেকে পাস করলেও সাবেক মেয়র মিনুর রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় তিনি রাসিকের বিদ্যুৎ বিভাগের দায়িত্ব পান। এরপর তিনি প্রভাব খাটিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীও হন। আওয়ামী লীগের কয়েকজন শীর্ষ নেতার সঙ্গেও সখ্য গড়ে তোলেন তিনি।
ঠিকাদারদের অভিযোগ, বিদ্যুৎ বিভাগের দরপত্রে বৈদ্যুতিক ঠিকাদারি লাইসেন্স বা এবিসি লাইসেন্স বাধ্যতামূলক হলেও রাসিকের দরপত্র আহ্বানে তা চাওয়া হয়নি। প্রকৌশলী রিটুর পছন্দের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসএলকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের এবিসি লাইসেন্স নেই। তাই এই লাইসেন্স না চেয়েই বারবার বিদ্যুৎ বিভাগের দরপত্র আহ্বান করা হচ্ছে। এ ছাড়া সর্বনিম্ন দরদাতা না হয়েও তিনবার কাজ পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ‘বিদ্যুৎ লাইসেন্সিং বোর্ড’-এর সচিব ইঞ্জিনিয়ার মো. আতোয়ার রহমান মোল্লা বলেন, ‘এবিসি লাইসেন্স ছাড়া বিদ্যুতের কোনো দরপত্রই আহ্বান করা যাবে না। অডিট হলে দরপত্র আহ্বানকারী প্রকৌশলীকে সরাসরি জেলে যেতে হবে। কোনো জবাব দিতে পারবেন না। প্রকৌশলী যাকে কাজ দেবেন তার হয়তো এবিসি লাইসেন্স নেই। তাই এবিসি লাইসেন্স না চেয়ে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। কেউ অভিযোগ দিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ‘
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের ১২ মে ৮৭ লাখ ৩০ হাজার টাকার ১৫ ওয়াটের ১০ হাজার পিস ও ৩২ ওয়াটের ১১ হাজার পিস এলইডি বাল্ব সরবরাহের টেন্ডার পায় এসএলকে ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড। তবে এই টেন্ডারে অংশ নেওয়া ৫টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এসএলকে ছিল চতুর্থ নম্বরে। কাগজপত্র ঠিক নেই অজুহাতে ১ম, ২য় ও ৩য় সর্বনিম্ন দরদাতাকে দেওয়া হয়নি এই টেন্ডার। এমন কী ওই টেন্ডারে নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে কাজের অভিযোগও রয়েছে। রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) ল্যাবে টেস্টে এই প্রমাণ পাওয়া গেছে। তারপরও ওই প্রতিষ্ঠানকে বিল দেওয়া হয়েছে।
এরপর ২০১৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বরে ৬৪ লাখ টাকার ১৫ ওয়াটের আট হাজার পিস এবং ৩২ ওয়াটের পাঁচশ’ পিস এলইডি বাল্ব সরবরাহের জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হয়। এই দরপত্রে ৪টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিলেও কাজ পায় তৃতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা ‘এসএলকে’। নির্দিষ্ট সময়ে কাজ করতে না পারায় মেয়াদ বাড়ানো হয়। সেই সময়ের মধ্যেও কাজ শেষ হয়নি। পরে এসএলকের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করার প্রস্তাব দেয় রাসিক। চুক্তি বাতিলের প্রস্তাব গ্রহণ করে রহস্যজনকভাবে জামানতের ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা ফেরত দেওয়া হয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। অথচ সরকারি ক্রয়নীতি অনুযায়ী, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে জামানতের সমস্ত অর্থ বাজেয়াপ্ত এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করার কথা। ঠিকাদারদের অভিযোগ, এসএলকেকে বাঁচানোর জন্য রাসিক নিজ থেকে চুক্তি বাতিলের প্রস্তাব দিয়েছে।
২০১৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর নগরের সাগরপাড়া থেকে রানীবাজার পর্যন্ত সড়কের বিদ্যমান বিদ্যুৎ লাইন অপসারণ এবং ১২ মিটার ও ৯ মিটারের নতুন জিআই পোল সরবরাহের আরও একটি কাজ দেওয়া হয় ওই প্রতিষ্ঠানকে। এখানেও দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েও ৪৪ লাখ ৮০ হাজার টাকার কাজটি পায় এসএলকে। তবে প্রতিষ্ঠানটি ১২ মিটার জিআই পোল সরবরাহ না করে নিম্নমানের এমএস পোল সরবরাহ করে। রুয়েটের পরীক্ষায় বিষয়টি ধরাও পড়ে। তারপরও কাজের বিল পরিশোধ করা হয়।
জানা গেছে, গত ৪ এপ্রিল পৌনে তিন কোটি টাকার আরেকটি টেন্ডার আহ্বান করে রাসিক। কাজটিতে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে এসএলকে। প্রথম সর্বনিম্ন দরদাতা অটো পাওয়ার লিমিটেডের চেয়ে ৮০ লাখ টাকা বেশি দর দেওয়ার পরও এসএলকে ইঞ্জিনিয়ারিংকেই কাজটি দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে বলে ঠিকাদারদের ধারণা। তাই দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও কাজটি দেওয়ার বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত নেয়নি কর্তৃপক্ষ।
এসব বিষয়ে রাসিকের বিদ্যুৎ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রেয়াজাত হোসেন রিটু বলেন, ‘বারবার কাজ পাচ্ছে একথা ঠিক নয়, তিনবার কাজ পেয়েছে। জানা ছিল না বলে দরপত্রে এবিসি লাইসেন্স চাওয়া হয়নি। তাদের কাজের মান খুব খারাপ হয়নি। অর্থের অভাবে রাসিক কাজের বিল দিতে পারছিল না, তাই রাসিক কাজ বাতিল করে জামানত ফেরত দেয়।’ চোরাই তার ব্যবহারের বিষয়টি জানা নেই বলে দাবি করেন প্রকৌশলী রেজায়াত হোসেন রিটু।
এ বিষয়ে এসএলকে ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাফানুর রহমান শিবলী বলেন, ‘দরপত্র আহ্বানে এবিসি লাইসেন্স চাওয়া হলে আমি ওই টেন্ডারগুলোতে অংশ নিতে পারতাম না। প্রকৌশলী রেজায়াত হোসেন রিটুর সঙ্গে কোনো রকম সখ্য নেই। নিয়ম অনুযায়ী কাজগুলো পেয়েছি। কাজের মান খারাপ হয়নি। আমাকে ১২ ফুট জিআই পোলের বিল দেওয়া হয়নি, ৯ ফুট পোলের বিলই দেওয়া হয়েছে। তদবির করিনি বলে রুয়েট টেস্টে ওই রকম রিপোর্ট এসেছে। ফান্ড নেই বলেই রাসিক একটি দরপত্র বাতিল করে জামানত ফেরত দেয়।’
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল বলেন, ‘বিষয়গুলো সম্পর্কে বিস্তারিত এখনও জানি না। অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখব।’
সৌজন্যে : দৈনিক সমকাল।