জাতির জনকের খুনিদের অন্যতম নূর চৌধুরী বর্তমানে কানাডার টরন্টো শহরে বাস করলেও সেখানে তার কোনও স্ট্যাটাস (নাগরিকত্ব বা অভিবাসন সংক্রান্ত) নেই। তিনি কানাডার সরকারের পক্ষ থেকে কোনও ধরনের সুযোগ সুবিধাও পান না। শুধু তাই নয়, তাকে নির্দিষ্ট সময় পরপর অভিবাসন অফিসে হাজিরাও দিতে হয়। তবুও দেশের ফেরত আনার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ যখনই নূর চৌধুরীকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানায়, তখনই তাতে অসম্মতি জানায় কানাডা।
তবে তাকে দেশে ফেরত আনার সুযোগ এসেছিল ২০০৬ সালে। ওই বছর নূর চৌধুরীর রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার আবেদন নামঞ্জুর করে কানাডা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, ২০০৬ সালে নূর চৌধুরীর রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার আবেদন নামঞ্জুরের পর তার কূটনৈতিক পাসপোর্ট অটোয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসে ফেরত দেওয়া হয় এবং তাকে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে কানাডা ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে। সেসময় নূর চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল হাইকোর্টে বিবেচনাধীন থাকায় তার মৃত্যুদণ্ড হবেই এটি নিশ্চিত ছিল না। তাই তাকে আনা যেত সহজেই। কিন্তু দেশে তখন চলছিল রাজনৈতিক পালাবদল। ফলে নূর চৌধুরীকে ফেরত আনার বিষয়টিতে জোরালো পদক্ষেপ ছিল না সরকারের।
তিনি আরও জানান, সরকারের নিস্পৃহতার সুযোগ নিয়ে কানাডার খ্যাতনামা অভিবাসন আইনজীবী বারবারা জ্যাকসনের কাছে যান নূর চৌধুরী এবং কানাডার অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসে ২০০৭ সালের মাঝামাঝি তাকে ফেরত না পাঠানোর জন্য আবারও আবেদন করেন। সেই থেকে নূর চৌধুরী ‘প্রি-রিম্যুভাল রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট’ বিধির সুযোগ নিয়ে কানাডায় আছেন।
ওই কর্মকর্তা জানান, নূর চৌধুরীর আবেদনে বলা হয়েছে তাকে দেশে ফেরত পাঠানো হলে তার মৃত্যুদণ্ড হবে। এখন পর্যন্ত সেই আবেদনের নিষ্পত্তি করেনি অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস।
উল্লেখ্য, কানাডা মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিপক্ষে। সে দেশের আইন অনুযায়ী, মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রাপ্ত কোনও ব্যক্তি কানাডায় অভিবাসী হলে ও জীবনাশঙ্কার কথা জানিয়ে আবেদন করলে সেই ব্যক্তিকে তার দেশে ফেরত পাঠানো হয় না।
সাবেক সেনা কর্মকর্তা নূর চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর ১২ খুনির একজন। ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে তিনি বাংলাদেশ ত্যাগ করেন এবং ১৯৭৬ সালে তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আত্মীকরণ করা হয়। নূরের প্রথম পোস্টিং ছিল ব্রাজিলের ব্রাসিলিয়ায়। পরবর্তীতে তাকে আলজেরিয়া ও হংকং এ বদলি করা হয়। তার শেষ পোস্টিং ছিল হংকং এ এবং সেখানে মিনিস্টার হিসেবে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত তিনি কর্মরত ছিলেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, নূর তার কূটনীতিক পাসপোর্ট নিয়েই হংকং থেকে ১৯৯৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে একই বছর তিনি কানাডায় প্রবেশ করেন।
সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ২০০৯ সালে কানাডার আইনমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে নূরকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ করেছিলেন তিনি। কিন্তু তিনি তাকে জানিয়ে দেন, কানাডার আইন অনুযায়ী তারা এটি করতে পারবেন না।
শফিক আহমেদ আরও জানান, নূর চৌধুরীর পাসপোর্ট তারা তখন বাংলাদেশ দূতাবাসে ফেরত দিয়ে দিয়েছিল।
তিনি আরও জানান, আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার আগে বাণিজ্যিক বিষয়ে অভিজ্ঞ একজন আইনজীবীকে নূর চৌধুরীর বিষয়ে তদারকি করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে একজন সংবিধান বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন ছিল।
কানাডার সবচেয়ে ভালো আইনজীবী নিয়োগ এবং তার অন্যান্য খরচের টাকা তিনি কোথা থেকে পান এটি জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা বলেন, এটি আমরা জানি না। কিন্তু কেউ তাকে খরচের টাকা দেয়।
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, বাংলাদেশ ২০১১ সালে কানাডাকে অনুরোধ করেছিল নূরকে যুক্তরাষ্ট্রে ফেরত পাঠাতে। যাতে করে তাকে বাংলাদেশে ফেরত আনা যায়। কিন্তু কানাডা সেটি করতে রাজি হয়নি। তাদের না বলার একটি কারণ ছিল নূরকে ফেরত পাঠানো হলে তাদের আরও অনেককেই ফেরত পাঠাতে হবে।