ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),ঢাকা প্রতিনিধি, সোমবার ১১ নভেম্বর ২০২৪ || কার্তিক ২৭ ১৪৩১ :
রাজধানী ঢাকার দ্বিতীয় বৃহত্তম ফ্লাইওভার ‘মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার’। আট কিলোমিটার দীর্ঘ এই অবকাঠামো রাজধানীর সাতটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ের ওপর দিয়ে আটটি এলাকার সড়ককে যুক্ত করেছে। এই ফ্লাইওভার ধরেই প্রতিদিন চলাচল করছে হাজার হাজার গাড়ি। নিচ দিয়েও রাত-দিন যাতায়াত অসংখ্য মানুষের। এছাড়াও ফ্লাইওভারের দুই পাশে রয়েছে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও আবাসিক ভবন। এতো ব্যস্ততম এই স্থানটি বেছে নিয়েছিল একটি চক্র। ফ্লাইওভারের ভেতরে কৌশলে রীতিমতো আস্তানা গেড়েছিল ছিনতাইকারীরা।
Advertisement
সম্প্রতি এই ফ্লাইওভারেই ছিনতাইয়ের শিকার হন শামীম খান নামে এক বেসরকারি চাকরিজীবী। তার ওপর হামলার পরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে আসে ছিনতাইকারীদের এই আস্তানাটি। তবে তারা পিলারের উপর উঠে কীভাবে আস্তানা তৈরি করলো, কীভাবে ওঠা-নামা করতো; এসব নিয়েও লোকজনের মধ্যে তৈরি হয়েছে নানা কৌতূহল।
আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত এই চক্রটি ফ্লাইওভারের অবকাঠামোগত গঠনকে ব্যবহার করে সুযোগ নিয়েছিল। ফ্লাইওভারের পিলারের ওপরে যে স্ল্যাবগুলো বসানো হয়েছে, সেগুলোর ভেতরে ফাঁপা। আর পিলারের পাশ দিয়ে ফাঁকা, অর্থাৎ ভেতরে ঢোকার মতো জায়গা রয়েছে। আর এতে করে পুরো ফ্লাইওভারেই তৈরি হয়েছে সুরঙ্গের মতো ফাঁপা জায়গা। গভীর রাতে সেখানেই অবস্থান নিতো ছিনতাইকারীরা। আর চক্রের কেউ কেউ বাইরে ওঁৎ পেতে থাকতো। রাতে ফ্লাইওভারের উপর কাউকে একা পেলে সহযোগিতার কথা বলে ভুল পথ দেখিয়ে দিতো ওই চক্রের কিছু নারী সদস্য। ভুল পথে কেউ গেলেই ফাঁদ পেতে বসা থাকা চক্রটির অন্যান্য সদস্যরা সুরঙ্গ থেকে বেড়িয়ে এসে আক্রমণ করতো, ছিনিয়ে নিতো সব।
বৃহস্পতিবার (১৭ আগস্ট) বিকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, এফডিসির মোড় থেকে মগবাজার মোড় পর্যন্ত বেশ কয়েকটি জায়গা দিয়ে ফ্লাইওভারের স্ল্যাবের ভেতরে ফাঁকা জায়গায় ঢোকা যায়। ভেতরের ফাঁকা জায়গাটাতে দিনের বেলাতেই এমন ঘুটঘুটে অন্ধকার যে, কেউ বসে বা শুয়ে থাকলে বোঝাও খুব মুশকিল। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে সেখানে আস্তানা গেড়েছিল চক্রটি। তারা সেখানে মাদক সেবনসহ অসামাজিক কর্মকাণ্ড চালাতো বলেও জানতে পেরেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
পুলিশ বলছে, মূলত পিলারের উপরে গোপন ওই আস্তানায় ওঠা-নামার জন্য কম্বলের কাপড় কেটে কেটে রশি বানিয়েছিল চক্রটি। সেই রশিটিতে বেশ কয়েকটি গিঁট দেওয়া ছিল, যেগুলোতে ধরেই উপরে উঠতো চক্রের সদস্যরা। ফ্লাইওভার ধরে চলাচল করা মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার ও সিএনজি চালক এবং পথচারীদেরই মূলত টার্গেট করতো চক্রটি। সুযোগ পেলেই কৌশলে থামতে বাধ্য করতো তারা।
সেদিন রাতে শামীমের সঙ্গে যা ঘটেছিল
গত ৯ আগস্ট রাত সাড়ে ১১টায় আরামবাগ থেকে পল্লবীর বাসার উদ্দেশে মোটরসাইকেল নিয়ে শান্তিনগর হয়ে ফ্লাইওভারে ওঠেন শামীম খান। পথিমধ্যে তেল শেষ হলে মগবাজার মোড় পার হওয়ার পরপরই মোটরসাইকেলটি বন্ধ হয়ে যায়। তিনি মোটরসাইকেলটি ঠেলে হোটেল সোনারগাঁও ক্রসিংয়ের দিকে এগোতে থাকেন। এমন সময় ফ্লাইওভারে দাঁড়িয়ে থাকা নারী শামীমকে একপাশ দিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। তার কথামতো শামীমও ফ্লাইওভারের একপাশে চলে আসেন। তখন ফ্লাইওভারের নিচের ‘আস্তানা’ থেকে মুহূর্তের মধ্যে দুই যুবক চাপাতি হাতে শামীমের সামনে হাজির। কিছু বোঝার আগেই শামীমকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকেন। এসময় অন্য দুটি মোটর সাইকেলের আরোহী এই দৃশ্য দেখে এগিয়ে এলে ছিনতাইকারী দুই যুবক পালিয়ে যায়। আর ওই নারীকে মোটরসাইকেল আসা যুবকরা বেঁধে রেখে ৯৯৯-এ (জাতীয় জরুরি সেবা) ফোন দিলে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে শামীমকে উদ্ধার করে।
এই ঘটনার পর ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে গত ১০ আগস্ট চার জনকে গ্রেফতার করেছে ডিএমপির হাতিরঝিল থানা পুলিশ। গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে দুই নারী শেফালী এবং মীম ঢাকার আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। জবানবন্দিতে ছিনতাইকারী চক্রটি কীভাবে ছিনতাই করে, কোথায় তাদের আস্তানা এসব বিস্তারিত তথ্য উঠে এসেছে।
আস্তানার বিষয়টি টের পাননি স্থানীয়রাও
মগবাজার মোড়ে তৈরি হওয়া আস্তানাটির পাশের পিলারটির পাশেই দুলাল মিয়ার চায়ের দোকান। তার ভাষ্যমতে, ‘রাতের বেলায় কিছু তরুণ-তরুণী ওই পিলারের নিচে প্রায়ই আড্ডা দিতে দেখেছেন। তবে উপরে কীভাবে ওঠে, কীভাবে এই আস্তানা তৈরি করেছে এটি তার কখনও চোখে পড়েনি। তিনি বলেন, ভাসমান কিছু ছেলে-মেয়ে রাতদিন ওই সড়ক দিয়ে চলাফেরা করে, বসে আড্ডা দেয়।’
এছাড়া পিলারটির কাছেই ‘হোটেল হাতিঝিল আবাসিক’। ওই হোটেলের এক কর্মচারী বলেন, ‘পিলারে কিছুদিন রঙের কাজ করেছে লোকজন, ফুল আঁকছে। উপরে অনেককেই উঠতে দেখেছি। দিনে রাতে শত শত মানুষ থাকে এখানে। ওখানে আসা ছিনতাইকারীদের শনাক্ত করা কঠিন। আমরা বিষয়টি দেখে অবাক হয়েছি। রাতদিন হোটেলের নিচে গেটে দায়িত্ব পালন করি। এখানে যে ছিনতাইকারীরা আস্তানা গড়েছে, এই ঘটনার পর সেটা জানলাম।’
এ প্রসঙ্গে হাতিঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি শাহ মো. আওলাদ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মীম নামে এক তরুণীকে গ্রেফতারের পর তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মগবাজার ফ্লাইওভারের নিচে পিলারের উপর ছিনতাইকারীদের একটি আস্তানার খোঁজ পাই। অনেক উপরে হওয়ায় প্রথমে সেখানে আমাদের পক্ষে যাওয়া সম্ভব হয়নি। পরবর্তী সময়ে আমরা ফায়ার সার্ভিসের সাহায্য চেয়ে তাদের খবর দেই।’
দিনে কাওরান বাজারে মাছ কাটার কাজ, রাতে ছিনতাই
গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘এই ছিনতাই চক্রটির প্রধান আকবর। আর চেক্রর অন্য সদস্যদের বেশিভাগই ভাসমান ব্যক্তি। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের দেখে দলনেতা আকবর পিলারের ওপরের আস্তানা থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ে পালানোর চেষ্টা করে। তবে হাত-পায়ে আঘাত পাওয়ায় পালাতে পারেনি। আকবরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায়— দীর্ঘদিন ধরে আকবর মগবাজার ফ্লাইওভার, কারওয়ান বাজারসহ আশপাশের এলাকায় ছিনতাইসহ নানা অপরাধ করে আসছিল।’
Advertisement
গ্রেফতার মীম, শেফালী ও রবিউল হোসেনসহ আরও কয়েকজন তার সহযোগী হিসেবে কাজ করে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এ চক্রের আরও কয়েকজনের নাম আমরা জানতে পেরেছি। তাদেরও শনাক্ত করা হয়েছে, ইতোমধ্যে তাদের নামও আমরা জানতে পেরেছি। তবে তারা ভাসমান হওয়ায় খোঁজে বের করতে দেরি হচ্ছে। এছাড়া গত ১০ আগস্ট মগবাজারের ওই আস্তানায় অভিযানের চালানো পর থেকে পুলিশ টহলও বাড়ানো হয়েছে এবং নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’
গ্রেফতার আকবর সম্পর্কে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘সে দিনে রাজধানীর কাওরানবাজারে মাছ কাটার কাজ করে। রাতের বেলায় ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দেয়। ছিনতাইয়ের পর ফ্লাইওভারের পিলারে ওপর ওই আস্তানায় অবস্থান করতো। আস্তানায় মাদক সেবনসহ বিভিন্ন ধরনের অনৈতিক কাজ করতো।’
Advertisement
সুড়ঙ্গের বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি শাহ মো. আওলাদ হোসেন বলেন, ‘যেহেতু একটি ঘটনা ঘটেছে। সুড়ঙ্গের বিষয়টি আমরা সিটি করপোরেশনকে অবগত করেছি। সুরঙ্গটি কীভাবে বন্ধ করবে, সেটি তারা ব্যবস্থা করবে। আমাদের কাজ যেটা— আমরা ওই এলাকায় নিরাপত্তা বাড়িয়েছি।’