অঢেল সম্পদের মালিক মতিউরের দুই স্ত্রীই (ভিডিও)

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম,(টিভি),বিশেষ প্রতিনিধি,শুক্রবার, ২৮ জুন ২০২৪, ১৪ আষাঢ় ১৪৩১ : জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মতিউর রহমানের দুই স্ত্রীর সম্পদ নিয়েও চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য উঠে আসছে। এর মধ্যে তার বৈধ-অবৈধ আয়ের মাধ্যমে অর্জিত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির বেশিরভাগই করেছেন প্রথম স্ত্রী এবং তার দুই সন্তান তৌফিকুর রহমান অর্ণব ও ফারজানা রহমান ইপসিতার নামে। মতিউরের টাকায় করা ব্যবসা, রিসোর্ট, জমিজমাও প্রথম স্ত্রী ও তার সন্তানদের নামেই বেশি। ইপসিতাকে প্রায় ৯ কোটি টাকা দিয়ে বাড়ি কিনে দিয়েছেন কানাডার অন্টারিও রাজ্যের ব্যারি সিটিতে। প্রথম স্ত্রীর ভাইবোনদের নামেও মতিউর করে দিয়েছেন স্থাবর-অস্থাবর অনেক সম্পদ। সেদিক থেকে দ্বিতীয় স্ত্রী ও তার ছেলে ইফাত সম্পদ পেয়েছেন কম। তারপরও যা পেয়েছেন সেটাও পরিমাণে খুব একটা কম নয়। এমনকি দ্বিতীয় শাশুড়িকে তার গ্রামের বাড়িতে একটি বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স বানিয়ে দিয়েছেন মতিউর। দুই স্ত্রীই মতিউরের অবৈধ আয়ের বরাতে অঢেল সম্পদের মালিক।

Advertisement

ছাগলকাণ্ডে নাম আসার পর প্রথম স্ত্রী নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা চেয়ারম্যান লায়লা কানিজ ওরফে লাকির পরামর্শেই দ্বিতীয় স্ত্রী সোনাগাজীর শাম্মী আখতার শিবলীর (শিবু নামেই তিনি বেশি পরিচিত) ঘরে জন্ম নেওয়া ছেলে মুশফিকুর রহমান ইফাতকে অস্বীকার করেন মতিউর।

সম্পদের খোঁজ নিতে গিয়ে মতিউরের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র থেকে জানা যায়, ২০২০ সালের আগস্টে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন মতিউর। ওই সময় তিনি রাজধানীর আনোয়ার খান মর্ডান হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা মতিউরের কাছে ওই সময় প্রথম স্ত্রী ও তার সন্তানদের নামে বিপুল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি থাকার বিষয়টি তুলে ধরে হিস্যা অনুযায়ী সম্পদ দাবি করেন শিবলী। ওই অবস্থায় তিনি প্রায় ৩০০ কোটি টাকার চেক স্বাক্ষর করিয়ে নেন বলে দাবি করেছেন মতিউরের ঘনিষ্ঠরা। তাদের মতে, মতিউরের ওই সময়ের ব্যাংক হিসাব যাচাই করলেই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে।

প্রথম স্ত্রীর যত সম্পদ 

মতিউর রহমানের প্রথম স্ত্রী লাকি ছিলেন রাজধানীর তিতুমীর কলেজের সহযোগী অধ্যাপক। বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের চাকরি ছেড়ে তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন। ২০২৩ সালে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা চেয়ারম্যান সাদেকুর রহমান মারা গেলে উপনির্বাচনে প্রার্থী হন তিনি। স্বামী এবং স্থানীয় সংসদ সদস্যের প্রভাবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান হন লাকি। জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটির দুর্যোগ, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ-বিষয়ক সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

শিক্ষক থেকে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া লাকির নামে-বেনামে প্রচুর সম্পদ থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। বিগত নির্বাচনী হলফনামা অনুযায়ী, বাড়ি-অ্যাপার্টমেন্ট-দোকান ও অন্যান্য ভাড়া থেকে বছরে তার আয় ৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা। কৃষি খাত থেকে আয় ১৮ লাখ টাকা। শেয়ার-সঞ্চয়পত্র-ব্যাংক আমানতের লভ্যাংশ থেকে আসে ৩ লাখ ৮২ হাজার ৫০০ টাকা। উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে সম্মানী পান ১ লাখ ৬৩ হাজার ৮৭৫ টাকা। এ ছাড়া ব্যাংকের সুদ থেকে ১ লাখ ১৮ হাজার ৯৩৯ টাকা আয় করেন। বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তার জমা রয়েছে ৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। লাকির কৃষিজমির পরিমাণ ১৫৪ শতাংশ। অকৃষি জমির মধ্যে রয়েছে রাজউকে পাঁচ কাঠার প্লট, সাভারে সাড়ে ৮ কাঠার জমি, গাজীপুরে ৫ কাঠা, পুবাইলে ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ ও ২ দশমিক ৯০ শতাংশ, পুবাইল থানার খিলগাঁও মৌজায় ৫ শতাংশ ও ৩৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ, গাজীপুরের বাহাদুরপুরে ২৭ শতাংশ, গাজীপুরের মেঘদুবীতে ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ, গাজীপুরের ধোপাপাড়ায় ১৭ শতাংশ, নরসিংদীর রায়পুরায় ৩৫ শতাংশ, ৩৫ শতাংশ ও ৩৩ শতাংশ, রায়পুরার মরজালে ১৩৩ শতাংশ, সোয়া ৫ শতাংশ, ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ, ২৬ দশমিক ২৫ শতাংশ ও ৪৫ শতাংশ, শিবপুরে ২৭ শতাংশ ও ১৬ দশমিক ১৮ শতাংশ, শিবপুরের যোশরে সাড়ে ৪৪ শতাংশ ও নাটোরের সিংড়ায় ১ একর ৬৬ শতাংশ।

এ ছাড়া দেশে-বিদেশে রয়েছে লায়লা কানিজ ও তার দুই সন্তানের বিপুল পরিমাণ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও দুবাইয়ে একাধিক বাড়ি ও ফ্ল্যাট রয়েছে তাদের নামে। নরসিংদী জেলা সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার ও উপজেলা সদর থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে রায়পুরার মরজালে ১০০ বিঘা জমির ওপর গড়ে তুলেছেন মরজাল ওয়ান্ডারল্যান্ড পার্ক, যা স্থানীয়দের কাছে ‘লাকি পার্ক’ নামে পরিচিত। পার্কের পাশেই দুই বিঘার ওপর রয়েছে বিলাসবহুল বাড়ি। বাড়ির সামনের সড়কের নামও দিয়েছেন লায়লা কানিজ লাকি সড়ক।

রায়পুরার স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, হলফনামায় দেওয়া সম্পদের বাইরেও তার নামে-বেনামে আরও অনেক সম্পদ রয়েছে। একজন কলেজ শিক্ষকের উপার্জন দিয়ে এত সম্পদের মালিক হওয়ার কথা নয়। এর সবকিছুই হয়েছে তার স্বামী মতিউর রহমানের অবৈধ উপার্জনের টাকায়।

রায়পুরা উপজেলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি নুর উদ্দিন খান জানান, লাকি উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েই সাংবাদিক ও আইনজীবীদের নিয়ে প্রকাশ্যে বেফাঁস মন্তব্য করেন। সস্তায় সাংবাদিক ও আইনজীবীদের কেনা যায়Ñ এমন মন্তব্য করার পর সমালোচনার মুখে নিঃশর্ত ক্ষমাও চান।

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জিএম তালেব হোসেন বলেন, দলে যোগ দেওয়ার পর দলীয় কর্মকাণ্ডে লাকির আর্থিক অবদান ছিল। তবে তার এসব টাকা বৈধ না অবৈধ তা আমার জানা নেই। যদি তিনি অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন করে থাকেন তাহলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী অবশ্যই তার বিচার হবে।

Advertisement

স্বামী-স্ত্রীতে বেড়েছে দূরত্ব 

ছাগলকাণ্ডের পর প্রথম স্ত্রী লাকির সঙ্গে মতিউরের দূরত্ব বেড়েছে বলে জানা গেছে। লাকির স্বজনদের দাবি, মতিউরের দ্বিতীয় বিয়ের খবর আগে জানতেন না তিনি। ছাগলকাণ্ডের আগ পর্যন্ত তিনি এ বিষয়ে অজ্ঞাত ছিলেন। তাদের মধ্যে সম্পর্কও ভালো ছিল। কিন্তু এখন তাতে ফাটল ধরেছে। দূরত্ব বেড়েছে দুজনের মধ্যে।

দেশ ছাড়তে পারেন যেকোনো সময় 

ছাগলকাণ্ডে নাম আসার পর এবং গণমাধ্যমে একের পর এক সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর নানা মহলে দৌড়ঝাঁপ করছেন মতিউর ও তার প্রথম স্ত্রী। তারা প্রভাবশালী এক আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন বলে জানা গেছে। ওই নেতা তাদেরকে আপাতত দেশের বাইরে গিয়ে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। সেটা মেনে যেকোনো সময় তারা দেশ ছাড়তে পারেন। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, লাকি বাংলাদেশ ও কানাডার দ্বৈত নাগরিক।

গত দুদিন ধরে লাকির ব্যবহৃত ফোনটি খোলা থাকলেও কোনো অপরিচিত নম্বর তিনি রিসিভ করছেন না। তার এলাকার একজন রাজনৈতিক কর্মী জানান, ছাগলকাণ্ডে নাম আসার পর লাকির মোবাইল ফোনে অনবরত রিং আসছে। সবাই একই প্রশ্ন করছে। এতে তিনি খুবই বিরক্ত।

দ্বিতীয় শাশুড়িকে ডুপ্লেক্স বাড়ি উপহার

মতিউরের দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার শিবলীর গ্রামে বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স বাড়ি বানিয়ে দিয়েছেন মতিউর। ১০ বছর আগে করা বাড়িটি সোনাগাজী উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নের সোনাপুর এলাকায়। স্থানীয়রা বাড়িটিকে মিয়াবাড়ি হিসেবে চেনেন।

প্রতিদিনের বাংলাদেশের ফেনী প্রতিবেদক আবদুল্লাহ আল মামুন বাড়িটি ঘুরে এসে জানান, মতিউরের করে দেওয়া বাড়িটি দেখাশোনা করছেন জসিম উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি। দুই মাস আগেও মতিউর, তার স্ত্রী শাম্মী, ছেলে ইফাত ও শাম্মীর মা (মতিউরের শাশুড়ি) ওই বাড়িতে থেকে গেছেন। দুদিন থেকে তারা ঢাকায় চলে যান। ইফাত এবার কোরবানির জন্য যেসব গরু ও ছাগল কিনেছেন তার মধ্যে চারটি গরু নানার বাড়িতে গিয়ে কোরবানি করে আত্মীয়স্বজনের মধ্যে বিলিয়েছেন বলে জানান এলাকাবাসী। বাড়িটি ছাড়াও সোনাগাজীতে মতিউর ও তার শ্যালক নকিবের নামে বেশ কিছু সম্পত্তি রয়েছে। শিবলীর নামে ধানমন্ডি ও কাকরাইলে ফ্ল্যাট ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে বিপুল পরিমাণ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

বিব্রত সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ

ছাগলকাণ্ডে আলোচিত মতিউর রহমান রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের পরিচালক। ব্যাংকের ওয়েবসাইটে পরিচালকদের তালিকায় তার নাম ও ছবি রয়েছে। ছাগলকাণ্ডের পর সোনালী ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা বিব্রত বলে জানিয়েছেন। ব্যাংকের একজন পরিচালকের কাছে জানতে চাইলে তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘তিনি (মতিউর) আমাদের একজন সম্মানিত পরিচালক। তার বিষয়ে পত্রপত্রিকায় যেসব খবর দেখছি সেটা সত্যিই বিব্রতকর।’

জানা গেছে, মতিউর রহমানকে যখন সোনালী ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগের জন্য চিঠি ইস্যু করা হয় তখন অর্থ সচিব ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। ২০২২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে মতিউর রহমানকে সোনালী ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগের জন্য একটি চিঠি ইস্যু হয়।

Advertisement

‘অভিযোগ প্রমাণিত হলে জেলে যেতে হবে’

মতিউর রহমান সম্পর্কে প্রকাশিত সংবাদের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বর্তমানে অধিকাংশ সরকারি কর্মকর্তার আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সঙ্গতি নেই। রাজস্ব বোর্ডের সদস্য মতিউর রহমানের বিষয়েও পত্রিকায় দেখেছি। তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে সেগুলো যদি সত্য হয় তাহলে ব্যাংকের পরিচালক পদে তার থাকার কোনো সুযোগ নেই। আর অপরাধ প্রমাণিত হলে তো তাকে জেলে যেতে হবে। তার তো তখন চাকরিই থাকবে না।

লায়লা কানিজ লাকি ও শাম্মী আখতার শিবলী। ছবি কোলাজ : প্রবা