ফরম পূরণের নামে দালাল চক্রের ফাঁদ (ভিডিও)

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম,(টিভি),ঢাকা প্রতিনিধি,শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ : খুপরির মতো দেখতে সারি সারি দোকান। সাইনবোর্ড দেখে বাইরে থেকে মনে হবে কম্পিউটার-ফটোকপির দোকান। কিন্তু ভেতরে ব্যবসা ভিন্ন। প্রকাশ্যে চলছে পাসপোর্ট নিয়ে জাল-জালিয়াতির কারবার। ভুয়া সিল প্যাড ব্যবহার করে তৈরি হচ্ছে যাবতীয় নকল কাগজপত্র। হাত বাড়ালেই মিলছে সব। পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সামনে এসব দোকান ঘর ঘিরেই তৎপর পাসপোর্ট দালাল চক্রের সদস্যরা। সরেজমিন গত এক সপ্তাহের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।

দেখা যায়, বেশিরভাগ পাসপোর্ট প্রত্যাশী ই-পাসপোর্টের ফরম পূরণ করতে গিয়ে দালালের ফাঁদে পড়ছেন। ফরম পূরণ শেষ হলেই দ্রুততম সময়ে পাসপোর্ট করার অফার দেয় দালালরা। পাসপোর্ট সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজের জন্য টাকার অংক ভিন্ন। যেমন: সিরিয়াল ছাড়া আবেদন জমা করতে ৫ থেকে ১৫ হাজার, পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়া পাসপোর্ট পেতে ২০ হাজার, নামের বানান সংশোধনে সর্বনিু ৩০ হাজার এবং জন্ম তারিখ সংশোধনে ৫০ হাজার থেকে ৩ লাখ পর্যন্ত টাকা চাওয়া হচ্ছে।

Advertisement

কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার মানিকারচর গ্রামের রাজনীতিবিদ ও তরুন নেতা তাজুল ইসলাম তাজ উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনে আনারস মার্কায় বিপুল ভোটে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

মেঘনাবাসীর পক্ষ থেকে অভিনন্দন ও লাল গোলাপের শুভেচ্ছা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পাসপোর্ট দালাল যুগান্তরকে বলেন, ‘অফিসে তাদের লোক আছে। পাসপোর্ট সংক্রান্ত সমস্যা শুনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে তারা ফোন দেন। সবুজ সংকেত পাওয়ার পর তারা কাজ হাতে নেন।’ কয়েকজন পাসপোর্ট দালাল আরও জানান, পাসপোর্ট দালালির কাজে তাদের প্রত্যেকের গড়ে দৈনিক আয় হয় ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এছাড়া পাসপোর্টের ‘বড় কাজ’ পেলে তো কপাল খুলে যায়। যেমন ভুয়া নাম-ঠিকানায় জাল পাসপোর্ট তৈরি, আঙ্গুলের ছাপ জালিয়াতি (মিসফিঙ্গারিং) ইত্যাদি কাজে লাখ টাকারও বেশি আয় করা যায়।

এ বিষয়ে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সেলিনা বানু দাবি করেন, ‘দালাল নির্মূলে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সব ধরনের চেষ্টা করা হচ্ছে। এজন্য র‌্যাব-পুলিশের সহায়তায় মাঝেমধ্যেই ভ্রাম্যমাণ আদালত চালানো হয়। আগের তুলনায় বর্তমানে কিছুটা হলেও দালাদের দৌরাত্ম্য কম।’

আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের দক্ষিণ পাশে গণপূর্তের বিশাল জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে কাঁচাবাজার ও আধাপাকা মার্কেট। মূলত এই বাজারই পাসপোর্ট দালালদের হাট বলে পরিচিত। এখানে টিনের বেড়া দিয়ে দোকানের আদলে গড়ে তোলা টংঘর যেন সোনার হরিণ। ছোট ছোট এসব ঘর ভাড়া পাওয়া যেন ভাগ্যের ব্যাপার। রীতিমতো প্রতিযোগিতামূলক দামে ভাড়া নেওয়া হয়। এ কারণে এখানকার ফাঁকা জায়গা থেকে শুরু করে ফুটপাত, কোনো কিছু দখল হতে বাকি নেই। এমনকি পয়ঃনিষ্কাশনের ড্রেনও দখল হয়ে গেছে। ড্রেনের ওপর কাঠের পাটাতন দিয়ে বানানো হচ্ছে অস্থায়ী দোকান।

এখানকার শতাধিক দোকানে দিনভর চলছে আজব এই ঘুস কমিশন ও জালজালিয়াতির কারবার। বেশিরভাগ দোকানে লোক দেখানোর জন্য রাখা আছে অকেজো কম্পিউটার এবং ফটোকপি মেশিন। সারাক্ষণ এখানে দালালদের প্রকাশ্য হাঁকডাক। কোনো আগন্তুক সামনে এলেই তারা সমস্বরে বলে ওঠেন, ‘কী কাজ ভাই? আসেন, বসেন। করে দিব। টাকা কম লাগবে। ইত্যাদি।’ নোংরা, দুর্গন্ধময় গলির শেষ প্রান্তে কয়েকটি ভাতের হোটেল, সেলুন এবং কাঁচা তরকারির দোকান। কিন্তু সেখানেও গিজ গিজ করছে দালাল চক্রের সদস্যরা। আমিন এন্টারপ্রাইজ, জিয়া এন্টারপ্রাইজ, আলিফ, মা ফাতেমা এন্টারপ্রাইজ এবং রশিদা এন্টারপ্রাইজ নামের দোকানে দালালদের যেন দম ফেলার ফুরসত নেই। নিমিষেই বানানো হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভুয়া সিল, প্যাড, আইডি কার্ড, হলফনামা এমনকি জাতীয় পরিচয়পত্র। পাসপোর্ট আবেদনের সঙ্গে জমা দেওয়া হচ্ছে এসব নকল কাগজপত্র।

Advertisement

দেখা যায়, নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ পাসপোর্ট সংক্রান্ত বহুবিধ সমস্যা নিয়ে দালালের শরণাপন্ন হচ্ছেন। এদের একটি বড় অংশ পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে সমাধান পাননি অথবা চরম হয়রানির শিকার হয়েছেন। গত রোববার জাকির হোসেন নামের এক যুবক আসেন চাঁদপুর থেকে। তার নামের আগে এমডি (সংক্ষিপ্ত মোহাম্মদ) ছিল। কিন্তু পাসপোর্টে এমডি প্রিন্ট হয়নি। অফিসের কর্তাব্যক্তিদের টেবিলে টেবিলে ঘুরেও সমাধান পাননি। অগত্যা এসেছেন দালালের কাছে।

বরিশালের বাসিন্দা রফিকুজ্জামান শ্রমিক ভিসায় সৌদি যেতে চান। নতুন পাসপোর্ট করতে হবে। কিন্তু তার জাতীয় পরিচয়পত্রে জন্ম তারিখ ভুল থাকায় পাসপোর্ট আবেদন জমা নেওয়া হচ্ছে না। অনেক চেষ্টা করেও সমস্যার সমাধান মেলেনি। মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা আইনাল হকের স্ত্রীর ভোটার আইডিতে নাম আছে মোসা: খাদিজা খাতুন। কিন্তু নতুন প্রিন্ট করা ই-পাসপোর্টে খাদিজার নামের বানান ভুল হয়ে গেছে। তিনিও এখন সমাধান পাচ্ছেন না। মিরপুরের দক্ষিণ বিশিল থেকে এসেছেন রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী জহুরুল হক। চিকিৎসার জন্য ভারতে যাবেন তিনি। জরুরি পাসপোর্ট দরকার। কিন্তু ডিসেম্বরের আগে আবেদন জমার ডেট পাচ্ছেন না। এ কারণে তিনিও দালালের শরণাপন্ন হয়েছেন।

Advertisement

সূত্র বলছে, এভাবে পাসপোর্ট দালালির সুবাদে অনেকেই এখন অঢেল সম্পদের মালিক। আগারগাঁওকেন্দ্রিক কোটিপতি পাসপোর্ট দালালদের মধ্যে অন্যতম চাঁদপুরের বাসিন্দা আব্দুল কাদের। তিনি আগে সোনালী ব্যাংকের পরিচ্ছন্নতা কর্মী ছিলেন। কর্মকর্তাদের ফুটফরমাসও খাটতেন। এক পর্যায়ে এখানে দালালের খাতায় নাম লেখান। কিছুদিন না যেতেই তার ভাগ্যের চাকা খুলে যায়। অসাধু পাসপোর্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে সখ্যের সুবাদে এক সময় তিনি আদম (বিদেশ গমনেচ্ছু শ্রমিক) পাসপোর্টের কাজ পেয়ে যান। এরপর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। রিক্রুটিং এজেন্টদের শত শত পাসপোর্ট জমা হতে থাকে তার মাধ্যমে। এরপর তিনি কোটিপতি। দালালির অঢেল টাকায় এক সময় পরিবহণ ব্যবসায় যুক্ত হন। তেজগাঁও এলাকায় আছে বিলাসবহুল অফিস। রীতিমতো ফুটপাত থেকে রাজপথে উঠে আসার গল্প। ছোট ভাই মোহসিন ও ভগ্নিপতি স্বপনকেও নামিয়েছেন বিনাপুঁজির লাভজনক এই দালালি ব্যবসায়।

Advertisement

র‌্যাবের গোয়েন্দা তালিকা অনুযায়ী আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে পুরনো দালালের সংখ্যা অন্তত দেড়শ। পাঁচ থেকে ১০ বছরের বেশি সময় ধরে দালালির কাজে তারা যুক্ত। এছাড়া আরও অন্তত ৫শ দালালের নাম পাওয়া গেছে। যারা ভাসমান। আগারগাঁওয়ে স্থায়ী দালালদের মধ্যে অন্যতম হলেন নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের সরকারবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা সোহেল, গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের জাকির হোসেন, মিরপুরের পূর্ব কাজীপাড়ার বজলু মিয়া, উত্তরখানের রুহুল আমিন, ময়মনসিংহের বাসিন্দা নুরুল আমিন, শেরেবাংলানগর এলাকার বাবুল হাওলাদার, মগবাজারের জয় আহসান, দক্ষিণ মনিপুরের মরিয়ম, সাভারের হেমায়েতপুরের যাদুরচর গ্রামের জীবন, আমিন এন্টারপ্রাইজের মালিক মনছুর আহমেদ ওরফে শাহিন, আরিফ, খোকন, খাইরুল, সোহেল, ছালেহা, টিপু ও শুক্কুর প্রমুখ।

সূত্র বলছে, আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসকেন্দ্রিক দালালদের নিয়ন্ত্রণ করেন আতর আলী নামের স্থানীয় এক প্রভাবশালী। গণপূর্তের ফাঁকা জায়গায় গড়ে তোলা অবৈধ বাজার এবং মার্কেটের নিয়ন্ত্রণও তার হাতে। এছাড়া জনৈক কাজল ও কুদ্দুস নামের কথিত রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে দালাল নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ রয়েছে।

Advertisement

পাসপোর্ট অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) শিহাব উদ্দিন খান যুগান্তরকে বলেন, ‘পাসপোর্ট ফরম আরও সহজ করা হলে দালালদের দৌরাত্ম্য কিছুটা হলেও কমবে। এছাড়া আবেদন গ্রহণের পর প্রতিটি ধাপের অগ্রগতি সম্পর্কে বাংলায় এসএমএস পাঠানো যেতে পারে। এতে অনেকেই উপকৃত হবেন। একইভাবে আবেদনের ভুলত্রুটি সম্পর্কেও এসএমএসের মাধ্যমে তথ্য জানানো যায়।