ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),ঢাকা প্রতিনিধি,শনিবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৩ : ‘টরন্টো’ কানাডার সবচেয়ে বড় ও ব্যস্ততম শহরগুলোর একটি। সিটি অব মাইগ্রেন্ট খ্যাত টরোন্টোয় বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ আসে নতুন জীবনের সন্ধানে। অনেকে যায় উচ্চ শিক্ষার জন্য। বাংলাদেশিরাও এর ব্যতিক্রম নয়। সেখানে ঢাকা-১৮ আসনের সংসদ সদস্য হাবিব হাসানের একমাত্র ছেলে আবির হাসান তানিমের নামে বাড়ির সন্ধান মিলেছে। কানাডায় পড়তে গিয়ে তানিম বাড়ি কেনার টাকা কোথায় পেলেন?
Advertisement
সেই অনুসন্ধান করতে গিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে অনুসন্ধানে। উত্তরা ও এর আশপাশের এলাকায় হাবিব হাসানের বিরুদ্ধে জমি দখল, চাঁদাবাজি, দলীয় নেতাকর্মীদের হামলা মামলা দিয়ে হয়রানীর অভিযোগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও দুদকে অভিযোগ দেয়া হয়েছে।
অনুসন্ধানে ধরা পড়ে, হাবিব হাসান ২০১৫ সালের কাউন্সিলর নির্বাচনের সময় হলফনামায় নিজেকে ৯ম শ্রেণি পাশ উল্লেখ করলেও পরে ২০২০ সালের এমপি নির্বাচনের সময় নিজেকে এসএসসি পাশ ঘোষণা করেন। অথচ তিনি এসএসসি পাশের যে সার্টিফিকেট জমা দিয়েছেন, সেটি ১৯৮১ সালের।
ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের গত কমিটির সহ-সভাপতি ছিলেন আবির হাসান তানিম। উচ্চ শিক্ষা নিতে গিয়েছিলেন কানাডায়। ট্রিনিটি ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করেন ২০১৮ সালে। তানিম কানাডায় পড়াশোনা করলেও দেশের রাজনীতিতে সক্রিয়।
অনুসন্ধান বলছে, ২০২০ সালে কীনস্কট রোডের ১৭ নাম্বার বাড়িটি কেনেন আবির হাসান তানিম। কাগজ কলমে বাড়িটির মালিকানায় আবির হাসান তানিমের নামের সঙ্গে তার স্ত্রী শার্মিলা সিজানার নামও রয়েছে। বাড়িটি কেনা হয় ১৫ লাখ ৫০ হাজার কানাডিয়ান ডলারে। যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় সাড়ে ১৩ কোটি।
টরন্টোর কীনস্কট রোডের বাড়ির বিষয়ে নিশ্চিত করেছেন কানাডায় প্রবাসী সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল ইমরান। তিনি জানান, বাড়িটি আবির হাসান তানিম ও শার্মিলা সিজানার নামে কেনা হয়েছে। তিনি আরও জানান, বাড়িটির দাম পনের লাখ পঞ্চান্ন হাজার কানাডিয়ান ডলার। যা বর্তমানে বাংলাদেশি টাকায় প্রায় সাড়ে ১৩ কোটি টাকা। বাড়িটির রেজিস্ট্রেশন ও অন্যান্য ফি-সহ প্রায় ১৫ কোটি টাকা খরচ হওয়ার কথাও জানিয়েছেন ইমরান। ইমরান আরও জানান, বাড়িটি বর্তমানে একটি আফগানী পরিবারের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়েছে।
হাবিব হাসান ২০২০ সালে এমপি নির্বাচনের সময় স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তিতে উল্লেখ করেছেন, অকৃষি নাল জমি আছে ১৫০ শতাংশ। যা তিন বিঘারও কম। কিন্তু তুরাগ থানার বাউনিয়া এলাকায় বিমানের রানওয়ের পাশ থেকে শুরু করে উত্তরা ১৭ নম্বর সেক্টর পর্যন্ত প্রায় ১১০ বিঘা সম্পত্তিতে নিজের নামে হাবিব সিটি ও বাবার নামে লতিফ সিটি ঘোষণা করেছেন বলে দুদকে করা অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।
সরজমিন অনুসন্ধানেও দেখা যায়, এই বিস্তীর্ণ এলাকা ঘিরে উঁচু ইটের প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। ১৭ নম্বর সেক্টরের পাশের অংশে গেইটের উপর লতিফ সিটি নামক সাইনবোর্ড টাঙ্গানো রয়েছে। এই সিটির দেয়ালের ভেতরে এক একর জমি আটকে রাখার অভিযোগ করেছেন সেলিনা রহমান ও তার ছেলে সৌরভ রহমান।
Advertisement
ভুক্তভোগীরা এমপির আপন ভাই নাদিম মাহমুদের বিরুদ্ধে সিনিয়র সহকারী জজ ২য় আদালতে মমলা করেছেন। ভুক্তভোগীদের পক্ষে কথা বলেছেন তাদের আইনজীবী সুশান্ত কুমার। তিনি বলেন, এমপির ভাই নাদিম মাহমুদ এমপির ক্ষমতায় তাদের জমি দখলের পায়তারা করছিলেন। তখন তারা আদালতে মামলা করেন। আদালতে উভয় পক্ষের শুনানি শেষে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আদেশ দেন। কিন্তু এমপির ভাই আদালতের সেই আদেশ অমান্য করে জমি দখল করে নেয়। পরে তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগও করা হয়েছে বলে জানান সুশান্ত কুমার।
হরিরামপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সহ-সভাপতি আতাউর রহমান ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন। আতাউর রহমান বলেন, নিজের চিকিৎসা করাতে সিদ্ধান্ত নেন জমি বিক্রির। আর তখনই লালশার শিকার হন এমপির। আতাউর অভিযোগ করেন, এমপি তাকে অফিসে নিয়ে আটকে রেখে তিন কোটি টাকার জমি এক কোটি টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রি করে নেন। এমপির নির্বাচনে টাকা খরচ হয়েছে, তাই সেই টাকা উঠাতে তিনি এমন করছেন বলেও অভিযোগ করেন আতাউর রহমান। এমপির বিরুদ্ধে জমি দখলের এমন আরও অনেক অভিযোগ রয়েছে।
সংসদ সদস্য হাবিব হাসান শুধু দখলদারিত্বেই থেমে থাকেননি। অভিযোগ রয়েছে, স্বার্থ হাসিলে নিজ দলের নেতাকর্মীদের মামলা-হামলায় জড়ানোর। প্রয়াত এমপি সাহারা খাতুনের অনুসারীরা হাবিব হাসানের বিরাগভাজন হয়েছেন। একই দলের হওয়া সত্ত্বেও ভিন্ন নেতার অনুসারী হওয়ায় দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হামলা-মামলা দিয়ে হয়রানির অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে কেউ কেউ ইতোমধ্যে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন। এমন বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়েছে।
তুরাগ থানা যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সাবেক সদস্য মোহাম্মদ সোহেল রানা বলেন, তিনি ছাত্রাবস্থা থেকেই হাবিব হাসানের সঙ্গে থেকে রাজনীতি করেছেন। কিন্তু বাউনিয়া এলাকায় জমি দখল ও চাঁদাবাজির জন্য এমপির লোকজনের সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়ান সোহেল। আর সেই অপরাধেই এমপি তাকে দুরে ঠেলে দিতে শুরু করেন।
সোহেল অভিযোগ করেন, এক পর্যায়ে এলাকার তুচ্ছ ঘটনাকাকে কেন্দ্র করেও সোহেলকে আসামি করে মামলা নিতে থানাকে বল প্রয়োগ করেন এমপি হাবিব হাসান। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আজকে আওয়ামী লীগ করেও আামার বিরুদ্ধে মামলা করায় আওয়ামী লীগেরই এমপি। তারও আবার ৮৫ বছর বয়সী স্কুল শিক্ষক বাবাকেও মারামারির মামলায় আসামি করা হয়।
প্রয়াত আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের রাজনৈতিক কর্মী হওয়ায় ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি নূর হোসেনও এমপির রোষানলে পড়তে হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। নূর হোসেন বলেন, এলাকায় একটি মরামারির ঘটনায় এমপির নির্দেশে সেই ঘটনায় হওয়া মামলায় একনম্বর আসামি করা হয় তাকে।
তিনি আরও বলেন, বিএনপির ওয়ার্ড কমিটির নেতার দায়ের করা মামলায় তাকে আসামি করতে ওসিকে নির্দেশ দিয়েছেন এমপি নিজেই। নিজে কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত না থাকার পরেও তাকে এভাবে মিথ্যা মামলায় জাড়ানোর জন্য ন্যায় বিচার চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। এমন অভিযোগ করেছেন খিলক্ষেত থানা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাহিনুর ইসলামও।
শাহিনুর বলেন, সাহারা খাতুন মারা যাওয়ার পর হাবিব হাসানের নির্বাচনের সময় মাঠে কাজ করার পরও তিনি তাদেরকে হয়রানি থেকে বাদ দেননি। শাহিনুর ও তার বড় ভাই মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সদস্য ও খিলক্ষেত থানা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক মো. রফিকুল ইসলামকেও মামলা দিয়ে হয়রানি করার অভিযোগ করেছেন তিনি। শাহিনুর বলেন, অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের অনুসারী হওয়াটাই এমপির বিরাগভাজনের একমাত্র কারণ বলেও তিনি দাবি করেন।
অনুসন্ধান বলছে, প্রয়াত সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের সঙ্গে যারা রাজনীতি করতেন, তাদের বেশিরভাগই এমপির বিরাগভাজন হয়েছেন। তাদের কেউ কেউ রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছেন, অনেকে রাজনীতি করলেও ভয়ে কথা বলতে চাননি। জনস্বার্থের স্লোগান তুলে রাজনীতিকে ক্ষমতার হাতিয়ার বানানো এখন নিত্য ঘটনা। যার সবশেষ এমপি হাবিব হাসান ও তার পরিবার।
Advertisement
এমপি হাবিব হাসানের কাছে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন। ছেলে আবির হাসান তানিমের নামে কানাডায় বাড়ির ব্যাপারে তিনি বলেন, আমার পরিবারের কেউ বিদেশে থাকে না। তাই বিদেশে সম্পত্তি কেনার প্রশ্নই উঠেনা। এছাড়া দখলবাজি ও দলীয় নেতাকর্মীদের হয়রানির বিষয়ে তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে এমন কোনো প্রমাণ কেউ দেখাতে পারবে না। এমন কোনো প্রমাণ কেউ দেখাতে পারলে রাজনীতি ছেড়ে দিবো।