পেটানোয় সবচেয়ে আগ্রাসী ছিলেন পরিদর্শক মোস্তফা এডিসি হারুন সাময়িক বরখাস্ত, পরিদর্শকও প্রত্যাহার (ভিডিও)

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),ঢাকা প্রতিনিধি ,মঙ্গলবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ : কেউ ছিলেন মুখোশে, কারও কারও পোশাকে ছিল না নেমপ্লেট। গত শনিবার রাতে রাজধানীর শাহবাগ থানায় ছাত্রলীগের দুই নেতাকে যখন পুলিশ সদস্যরা নির্মমভাবে দল বেঁধে পেটাচ্ছিলেন, তখন তারা চেষ্টা করেছেন পরিচয় লুকাতে।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল শাখার সভাপতি আনোয়ার হোসেন নাঈমকে পেটানো হয় থানার পরিদর্শকের (তদন্ত) কক্ষে।

Advertisement

ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে নির্যাতনে অংশ নেওয়া পুলিশ সদস্যদের পরিচয়। তাদেরই একজন শাহবাগ থানার পরিদর্শক (অপারেশন) গোলাম মোস্তফা। দুই নেতাকে পেটানোর সময় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এডিসি) হারুন অর রশিদের সঙ্গে সবচেয়ে আগ্রাসী ছিলেন তিনি। এরই মধ্যে গতকাল সোমবার রাতে পরিদর্শক মোস্তফাকে কর্মস্থল থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে বলে সমকাল নিশ্চিত হয়েছে।

এদিকে এ ঘটনায় পুলিশের রমনা বিভাগ থেকে বদলি হওয়া এডিসি হারুনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতির আদেশে গতকাল বিকেলে প্রজ্ঞাপনে সই করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, হারুন অর রশিদকে জনস্বার্থে সরকারি কর্ম থেকে বিরত রাখা আবশ্যক ও সমীচীন। তাঁকে সরকারি চাকরি আইনের বিধান অনুযায়ী ১১ সেপ্টেম্বর সরকারি চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো। প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, সাময়িক বরখাস্তকালীন এডিসি হারুন পুলিশ অধিদপ্তরে সংযুক্ত থাকবেন এবং বিধি অনুযায়ী খোরপোশ ভাতা প্রাপ্য হবেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক সমকালকে বলেন, নির্যাতনে যারা জড়িত তাদের সবাইকে খুঁজে বের করা হবে। তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাঈম এবং শহীদুল্লাহ হলের সাধারণ সম্পাদক শরীফকে শনিবার রাতে পিটিয়ে রক্তাক্ত ও দাঁত উপড়ে ফেলার ঘটনায় দেশজুড়ে চলছে তোলপাড়। সমালোচনার মুখে রোববার দুপুরে হারুনকে রমনা বিভাগ থেকে প্রত্যাহার করে ঢাকার ভেতরেই পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্টে সংযুক্ত করা হয়। পরে বিকেলে পুলিশ সদরদপ্তর হারুনকে ঢাকার বাইরে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে (এপিবিএন) বদলি করে। এ ঘটনায় রোববার তিন সদস্যের বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে ডিএমপি। কমিটির প্রধান করা হয়েছে ডিএমপি সদরদপ্তরের উপকমিশনার আবু ইউসুফকে। তিনি সমকালকে বলেন, এরই মধ্যে আমরা কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। সিসি ক্যামেরার একাধিক ফুটেজও নিচ্ছি। নির্যাতনের শিকার ছাত্রলীগ নেতা ও অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এ ছাড়া রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব আজিজুল হক ও তাঁর স্ত্রী ডিএমপির আরেক এডিসিকেও জিজ্ঞাসাবাদ করব। তাদের ঘিরেই ঘটনার সূত্রপাত। আগামী দু’দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেব।

এদিকে নির্মম নির্যাতেনর শিকার আনোয়ার হোসেন নাঈমের সুচিকিৎসায় পাঁচ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নাঈম বলেন, জ্ঞান হারানোর আগে আমি নিজের পরিচয় দিয়েছি। এর পর এডিসি হারুন আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। ১০ থেকে ১২ পুলিশ সদস্য আমার ওপর হামলে পড়েন। তারা বুট দিয়ে মারতে থাকেন। এডিসি হারুন ছাড়া সবাই পোশাক পরিহিত ছিলেন। কারও কারও নেমপ্লেট ছিল না। মুখোশ ও বড় মাস্ক ছিল তাদের।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হারুনের নির্দেশে নাঈমকে বেধড়ক পেটান পরিদর্শক (অপারেশন) গোলাম মোস্তফা। তবে মারধর শুরু করেছিলেন হারুন নিজেই।
এদিকে ছাত্রলীগের দুই নেতাকে নির্যাতনকারী এডিসি হারুনকে স্থায়ী বরখাস্তের দাবিতে মানববন্ধন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীরা। গতকাল দুপুরে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে আয়োজিত এ কর্মসূচিতে ঢাবির গাজীপুর ছাত্রকল্যাণ সমিতি ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে ছাত্রলীগের নানা স্তরের নেতাকর্মী অংশ নেন।

এডিসি হারুনকে স্থায়ীভাবে বরখাস্তের দাবি জানিয়েছে ছাত্র ইউনিয়নও। ঢাবি শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি শিমুল কুম্ভকার ও সাধারণ সম্পাদক আদনান আজিজ চৌধুরী যৌথ বিবৃতিতে এ দাবি জানান।
এ ব্যাপারে সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক সমকালকে বলেন, ভুক্তভোগী দুই ছাত্রলীগ নেতা চাইলে জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন। বিচার চাওয়ার অধিকার তাদের রয়েছে। অবৈধভাবে তাদের আটকে নির্যাতন করা হয়েছে। পুলিশ বাহিনীর সদস্য হিসেবে এটা তারা করতে পারেন না।

প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান

বারডেম হাসপাতাল ভবনের চতুর্থ তলায় ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল ও রিসার্চ সেন্টার। হাসপাতালের আউট পেশেন্ট ডিপার্টমেন্টে (ওপিডি) শনিবার রাতে এডিসি হারুনের সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতাদের বিতণ্ডা হয়। হাসপাতালটির প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা মতিউর রহমান সমকালকে বলেন, ওই নারী পুলিশ কর্মকর্তা ইটিটি করতে এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন এডিসি হারুন। পরে নারী কর্মকর্তার স্বামী সেখানে আসেন। এর পর ঝামেলা শুরু হয়। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন এমন একাধিক ব্যক্তি সমকালকে জানিয়েছেন, ইটিটি কক্ষের সামনে এসে রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হক তাঁর পুলিশ কর্মকর্তা স্ত্রীকে এডিসি হারুনের সঙ্গে আড্ডা দিতে দেখেন। এতে তিনি ক্ষুব্ধ হন এবং হারুনের কাছে জানতে চান– কেন তিনি তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছেন। তাদের মধ্যে তর্ক বাধে। এ সময় ওই নারী পুলিশ কর্মকর্তা উত্তেজিত হয়ে তাঁর স্বামীকে উল্টো প্রশ্ন করেন– ‘তুই কে? তোকে চিনি না।’ এতে আরও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন আজিজুল। তাঁর সঙ্গে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা আনোয়ার ও শরীফ ছিলেন। তাদের সঙ্গেও হারুনের বাগ্‌বিতণ্ডা শুরু হয়। এক পর্যায়ে তা হাতাহাতিতে গড়ায়। হাসপাতালের নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মীরা ছুটে এসে ঠেকানোর চেষ্টা করেন। এ সময় নিরাপত্তা বিভাগের সুপারভাইজার ওয়াছের আলীও কিল-ঘুসিতে আহত হন। এ পরিস্থিতি দেখে হাসপাতালের এক কর্মচারী জাতীয় জরুরি সেবা-৯৯৯ এ ফোন করেন। এর আগেই এডিসি হারুন শাহবাগ থানায় ফোন করে ১০ থেকে ১৫ পুলিশ সদস্যকে ডেকে আনেন। তখন দুই ছাত্রলীগ নেতাকে হারুন ধরে নিয়ে যান।

কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ

এডিসি হারুনকে সাময়িক বরখাস্তের আগে সোমবার দুপুরে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ডিএমপি কমিশনারের সঙ্গে দেখা করেন। ডিএমপি কার্যালয় থেকে বেরিয়ে ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ডিএমপি কমিশনার আমাদের আশ্বস্ত করেছেন– বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। আমরা মামলা করতে চাই না। তিনি বলেন, যে অনাকাঙ্ক্ষিত ও দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে, তাতে বাংলাদেশের সব শ্রেণির নেতাকর্মীর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। এ ঘটনায় ছাত্রলীগ যে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে, এর ওপর ভিত্তি করে বলতে পারি, একটি নিয়মতান্ত্রিক সমাধান পাব।

Advertisement

সাদ্দাম হোসেন বলেন, ডিএমপি কমিশনার আমাদের বলেছেন, তারা এ বিষয়ে বিব্রতবোধ করছেন। এ ছাড়া আমরা ডিএমপিকে বলেছি, এ ঘটনায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে যা যা করণীয় তারা যেন তা-ই করেন।
ভুক্তভোগীদের পরিবারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, তারা মামলা করতে চাইলেও ছাত্রলীগ নিষেধ করছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগ সভাপতি বলেন, ভুক্তভোগী পরিবারের এ দাবি মিথ্যা।

এ ঘটনায় ছাত্রদলের উদ্বেগের বিষয়টিকে ছাত্রলীগ কীভাবে দেখছে– জানতে চাইলে এ ছাত্রলীগ নেতা বলেন, যারা এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায়, তাদের বিষয়ে আমরা সতর্ক আছি। যারা দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ব্যত্যয় এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে চায়, তাদের ফাঁদে ছাত্রলীগ পা দেবে না।

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, ছাত্রলীগের নেতারা ডিএমপি কমিশনারকে বলেছেন, এ ঘটনায় সংগঠনের নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ। এডিসিকে বদলি করা কোনো শাস্তি নয়। তাঁর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হবে।

ফেসবুকে নানা প্রচারণা

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব আজিজুল হকের সঙ্গে ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে ঘটনার জেরে এডিসি হারুন এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। ছাত্রলীগ নেতাদের ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন আজিজুল। তবে একটি গ্রুপ ফেসবুকে গুজব ছড়াচ্ছে– হারুনের সাবেক স্ত্রী ৩৩তম বিসিএসের ওই নারী এডিসি। তবে সমকালকে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, ওই নারী পুলিশ কর্মকর্তা এডিসি হারুনের সাবেক স্ত্রী নন।

এটি ব্যক্তির দায়

ডিএমপি পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপারেশন) বিপ্লব কুমার সরকার বলেছেন, কোনো ব্যক্তির দায় পুলিশ নেবে না। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় দুই নেতাকে মারধরের ঘটনায় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের পর কাকে কতটুকু দায়ী করবে, তার ভিত্তিতে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কেউ চাকরিচ্যুত হতে পারেন, কেউ তিরস্কৃতও হতে পারেন।  গতকাল বিকেলে ডিএমপি সদরদপ্তরে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, ছাত্রলীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ডিএমপি কমিশনারের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। সরাসরি একজন ভুক্তভোগীও এসেছিলেন। তারা তাদের মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে তাদের বেশকিছু দাবি-দাওয়া উপস্থাপন করেছেন।
ডিএমপি কমিশনারের বক্তব্য পরিষ্কার জানিয়ে বিপ্লব বলেন, বাংলাদেশ পুলিশ অত্যন্ত পেশাদার একটি সংস্থা। একেবারেই নিরপেক্ষ এবং কারও প্রতি পক্ষপাতিত্ব না করে পেশাদারিত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হবে।
ভুক্তভোগী নাঈমের দাবি, এডিসি হারুনের সঙ্গে আরও ১০ থেকে ১২ পুলিশ থানায় তাকে মারধর করে। প্রত্যেকের শাস্তি নিশ্চিত করার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ডিএমপির এ কর্মকর্তা বলেন, শতভাগ নিশ্চিত থাকেন– তদন্ত কমিটি যাকে যতটুকু দায়ী করবে, তার অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।

রদবদল

এডিসি হারুনের স্থলে রমনা বিভাগের এডিসি হয়েছেন ডিবি-মতিঝিল বিভাগের খিলগাঁও জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার শাহ্ আলম মো. আখতারুল ইসলাম। এ ছাড়া পরিদর্শক মোস্তফার স্থলে শাহবাগ থানার পরিদর্শক (অপারেশন) করা হয়েছে আরশাদ হোসেন আকাশকে।

Advertisement

ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি মানবাধিকার কমিশনের

গতকাল জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় একজন পুলিশ কর্মকর্তার এমন আচরণ আইন ও নীতিবিরুদ্ধ। কমিশন মনে করে, তদন্তসাপেক্ষে ঘটনায় জড়িত পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণসহ নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

হারুন-অর-রশিদ, গোলাম মোস্তফা