ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),ঢাকা প্রতিনিধি,বৃহস্পতিবার, ৩১ মার্চ ২০২২ : গরিব বাবার ঘরে জন্ম। বালিকা বয়সে বিয়ে। স্বামীর পরিবারে অশান্তি। অতঃপর বেছে নেওয়া ভবঘুরে জীবন। এভাবেই কেটে গেছে ৬৭টি বসন্ত! নিজ কণ্ঠ গুণে পেয়েছেন পরিচিতি। হয়েছেন দেশখ্যাত। তবুও মেলেনি সুখের সন্ধান। সয়ে যাওয়া এই যাপিত জীবনকে এক কথায় বলা যায় ‘দুর্বিষহ’।
বলা হচ্ছিল লোকশিল্পী কাঙ্গালিনী সুফিয়ার কথা। সাভারের নবীন মার্কেট এলাকায় ছোট্ট একটি ঘরে এই শিল্পীর বর্তমান ঠিকানা। সম্প্রতি জীবনের প্রতি বাঁকে কাটিয়ে আসা নানান গল্প রাইজিংবিডিকে শুনিয়েছেন তিনি।
কাঙ্গালিনী সুফিয়া এক সময় নিয়মিত গান গাইতে পারলেও অসুস্থতার পর ২-৩টির বেশি গান টানা গাইতে পারেন না। খোঁজ নেয় না রেকর্ডিং প্রতিষ্ঠানও। সরকারিভাবে মাসে ১০ হাজার টাকা ভাতা পান। কিন্তু অভাবের সংসারে তা সামান্যমাত্র। এই লোকশিল্পী এখন মেয়ের সংসারে থাকেন। মেয়েজামাইও পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী।সংসারে আয়ের মানুষ নেই বললেই চলে।
যে কণ্ঠ দিয়ে তার পরিচিতি, সেই কণ্ঠের গান ইউটিউবে দিয়ে অনেকেই টাকা উপার্জন করছেন। কিন্তু কাঙ্গালিনীর কপালে জোটেনি কিছুই। ওষুধ কিনলে ভাত হয় না, ভাত কিনলে ওষুধ হয় না। এভাবেই কাটছে জীবন। শেষ সময়ে খেয়ে পড়ে এই সয়ে যাওয়া জীবন নিয়েই বেঁচে থাকতে চান তিনি। এছাড়া জীবনে যে গান-বাজনা করেছেন তার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চান বেঁচে থাকতেই। মরার পরে এসব দিয়ে কী হবে- এমন প্রশ্ন তার।
কাঙ্গালিনী সুফিয়া জানান, রাজবাড়ি জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার রামদিয়া গ্রামে ১৯৫৫ সালে তার জন্ম। নাম অনিতা হালদার। ডাক নাম বুচি। ছেলেবেলায় গ্রামের পাশেই সোনাপুরের বৈষ্ণব আখড়ায় গান শুনতে যেতেন। প্রথম গান শেখা সেখানেই। তবে গান গাওয়া চালিয়ে যেতে পারেননি। ১২ বছর বয়সেই বিয়ে হয়ে যায়। স্বামীর মারধরে সুখ ছিল না সেই সংসারে। ছাড়তে হয় সংসার। শিশু মেয়ে পুষ্পকে মায়ের কাছে রেখে বাবার হাত ধরে আশ্রয় নেন বৈষ্ণব আখড়ায়। শুরু হয় গানের জগতে পথচলা।
এর মধ্যেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। আখড়ায় পাকিস্তানি সেনারা হামলা চালালে তার আশ্রয় হয় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে। এ সময় সীমান্তবর্তী মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প লালগোলায়ও থেকেছেন তিনি। সেখানেই পরিচয় হয় মুক্তিযোদ্ধা মান্দার ফকিরের সঙ্গে। দেশ স্বাধীনের পর মান্দার ফকিরের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের ভাঙ্গায় চলে যান অনিতা। ধর্মান্তরিত হয়ে তার নাম হয় সুফিয়া খাতুন। কালে কালে দেশে ক্ষমতায় আসে রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে কণ্ঠশিল্পীদের বিদেশ সফরে পাঠানো হয়। সেই তালিকায় ঠাঁই পান সুফিয়া খাতুন। কিন্তু তার দুরবস্থার কথা শুনে এরশাদ নাম দেন ‘কাঙালিনী’। তখন থেকেই ‘কাঙ্গালিনী সুফিয়া’ তার নাম।
এই শিল্পী বলেন, আগে আমি নিয়মিত গান বাজনা করতে পারতাম। গ্রাম-গঞ্জের অনুষ্ঠানে ডাক পেতাম। বড় অনুষ্ঠানে ডাক পেতাম। সেসব থেকে যে রোজগার হতো তা দিয়ে সংসার চলতো। কিন্তু আমি ৪-৫ বছর ধরেই অসুস্থ। এ কারণে আর কেউ গান গাইতে ডাকে না। গান না গাইতে পারায় আমার দিন এখন খুব কষ্টে যাচ্ছে।
তিনি আক্ষেপের সুরে বলেন, মাসে প্রায় ১২ হাজার টাকার ওষুধ লাগে আমার। সরকার দেয় ১০ হাজার টাকা। আমার আর্থিক অবস্থা চিন্তা করে যদি টাকা বাড়িয়ে দিত তাহলে চলতে অসুবিধা হতো না। এছাড়া আমি জানতে পেরেছি আমি যেসব গান করেছি সেই গান নাকি অনেকে ইউটিউবে ছেড়েছে। সেখানে তারা ভালো আয় করে। তারাও যদি একটু আমার পাশে দাঁড়াত আমার কষ্ট হয়তো কিছুটা কমে যেতো। এজন্য আমি তাদেরও সহায়তা চাই।
এই লোকশিল্পী বলেন, শেখ হাসিনার সরকার আমার অনেক উপকার করেছে। পাশে থেকেছে। তবে আজীবন গান গেয়েও আমি দেশের কাছ থেকে বড় কোনো স্বীকৃতি পেলাম না। আমাকে যদি একুশে পদক বা স্বাধীনতা পদক দেওয়া হতো আমি ধন্য হতাম। আমার জীবনে আর তেমন কিছুই চাওয়ার নেই।
অসুস্থতায় ঘরবন্দি কাঙ্গালিনী সুফিয়ার সময় কাটে নিজের জীবনের দুঃসহ স্মৃতির কথা মনে করে। একা হাঁটতে পারেন না। কথা শুনতে পারেন না ভালোভাবে। জীবন সায়াহ্নে এসে পরাণের বান্ধবের খোঁজ পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে বলেন, জীবন নামের ‘বুড়োর’ মন তো পাওয়া হলো না। জীবন কেটে গেলো একটা মন খুঁজতে খুঁজতেই।