ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),ষ্টাফ রিপোর্টার,২৫ অক্টোবর : জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলে নেতৃত্বের দায়িত্ব পেয়েছেন মাত্র ১৩ মাস। এরই মধ্যে এন্তার অভিযোগ উঠেছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে অন্যতম হলো উৎকাচের বিনিময়ে বাছবিচার ছাড়াই সংগঠনের নানা পদে লোক বসানো। দুই শীর্ষ নেতা এ ক্ষেত্রে সবাইকে ছাড়িয়ে। তাঁরা ভাগ-বাটোয়ারা করেই এসব করে চলেছেন। আর অযোগ্যরা গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন।
বিএনপির অন্যতম অঙ্গসংগঠন হলো এর ছাত্রসংগঠন। ছাত্রদলের শক্তিমত্তায় ভর করেই বিএনপি বরাবর প্রতিরোধ কর্মসূচি দিয়ে এসেছে। ১৯৭৯ সালের ১ জানুয়ারি আত্মপ্রকাশের পর থেকে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ নানা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সংগঠনটি নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় থেকেছে। আশি ও নব্বইয়ের দশকে দেশের অন্যতম প্রধান ছাত্রসংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত বিএনপির ভ্যানগার্ড সংগঠনটি এখন অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এই অবস্থার জন্য মূলত দলটির নেতাদের ব্যর্থতাই দায়ী।
ছাত্রদলের বর্তমান কমিটি গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর কাউন্সিলের মাধ্যমে গঠিত হয়। এই কমিটিতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান ফজলুর রহমান খোকন ও ইকবাল হোসেন শ্যামল। তাঁদের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটিতে রয়েছেন ৬০ জন সদস্য।
ছাত্রদলকে সরাসরি দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তাঁর নির্দেশে সারা দেশে ছাত্রদলের যোগ্য ও জনপ্রিয় নেতাদের খুঁজে বের করতে ১০টি সাংগঠনিক টিম গঠন করা হয়। এই টিমের কাজ হচ্ছে জেলা ও উপজেলায় গিয়ে খুঁজে খুঁজে যোগ্য নেতৃত্ব সুপারিশ করা। কেন্দ্রের কাজ হবে উপজেলার ক্ষেত্রে জেলার সঙ্গে সমন্বয় করে কমিটি অনুমোদন করা। জেলার ক্ষেত্রে বিভাগীয় টিমের সঙ্গে সমন্বয় করে কমিটি ঘোষণা করবে কেন্দ্র।
জানা গেছে, সব টিমের সঙ্গে ভার্চুয়াল মাধ্যমে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখেন তারেক রহমান। দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতার সঙ্গে যোগাযোগের এই সুযোগকে অনেক নেতা টাকা কামানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। স্বেচ্ছাচারিতা, খামখেয়ালি, নিজের লোককে প্রতিষ্ঠিত করা, অর্থ লেনদেনের মতো ঘটনা অহরহ ঘটাচ্ছেন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। তাঁদের দেখে অন্য নেতারাও আশকারা পেয়েছেন।
জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের গঠন করা সাংগঠনিক টিম মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার সর্বস্তরে বৈঠক করে আরমান হোসেন লিমনকে আহ্বায়ক ও আশ্রাফুল ইসলাম শুভকে সদস্যসচিব করে আহ্বায়ক কমিটি জমা দেয় কেন্দ্রে। তাতে সায় দেন জেলা ছাত্রদল ও উপজেলা বিএনপির নেতারা। সেই কমিটি কেন্দ্রে এসে বদলে যায়। সদস্যসচিবকে ৪ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক রেখে জহিরুল ইসলাম বাদশাকে তাঁর স্থানে রাখা হয়েছে।
কোন যোগ্যতায় এমনটি করা হয়েছে—ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি)’র পক্ষ থেকে জানতে চাইলে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সদুত্তর দিতে পারেননি। শুধু বলেন, ‘উপরের চাপ আছে।’ একই প্রশ্ন শ্রীনগর বিএনপি এবং ছাত্রদল নেতাদেরও। এমনকি দায়িত্বপ্রাপ্ত টিমও বিষয়টি জানতে চেয়েছে। সবাইকে বলা হয়েছে, বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী এই নির্দেশ দিয়েছেন।
রিজভীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এমন কোনো কথাই আমি ছাত্রদলের নেতাদের বলিনি।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি আওলাদ হোসেন উজ্জ্বলের ভাতিজা হলেন এই জহিরুল ইসলাম বাদশা। তিনি তিন-চার বছর সৌদি আরবে থেকে কয়েক মাস আগে দেশে আসেন। সদস্যসচিবের পদ পেতে তিনি ছাত্রদলের শীর্ষ দুই নেতাকে দুই লাখ টাকা উৎকাচ দিয়েছেন।
নিয়ম অনুযায়ী উপজেলা কমিটি গঠন করতে হলে জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের স্বাক্ষর থাকতে হবে। আপত্তি থাকায় তাঁরা পরিবর্তিত কমিটিকে অনুমোদন দেবেন না জানালেও কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ক্ষমতার অপব্যবহার করে কমিটি ঘোষণা করেন।
সরকারি মাদরাসা-ই-আলীয়া ছাত্রদলের পক্ষ থেকেও একই ধরনের অভিযোগ করা হয়। তাদের এক চিঠিতে বলা হয়, অছাত্রদের দিয়ে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করতে অর্থের লেনদেন হয়েছে। এসব না করতে কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়। গত ১৩ সেপ্টেম্বর সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ছাত্রদলের পক্ষ থেকে বলা হয়, সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ১৮ জনকে দিয়ে কমিটি করতে চাইছেন। অথচ এঁদের মধ্যে ১৪ জনেরই এই কলেজে ছাত্রত্ব নেই। এখানে আর্থিক লেনদেন করছেন নেতারা।
বান্দরবান জেলা ছাত্রদল থেকে গত ৫ অক্টোবর কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বরাবর চিঠি দেওয়া হয়। তাতে বলা হয়, বিভাগীয় টিম স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর যে কমিটি গঠন করেছিল তা কেন্দ্রে গিয়ে পাল্টে গেছে। তাতে দীর্ঘদিন রাজনীতিতে না থাকা, রাজনীতি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেওয়া, অছাত্র ও বিবাহিতদের দিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটিতে স্বাক্ষর করার জন্য বিভাগীয় টিম চাপ দিচ্ছে। জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বিষয়টি তদন্তে কমিটি গঠনের দাবি জানানো হয়।
চট্টগ্রাম হাটহাজারীতে ঘোষিত কমিটির আটজনই বিদেশে থাকেন। সহকারী ত্রাণ ও পুনর্বাসন সম্পাদক আমজাদ হোসেন সুমন ঢাকায় চাকরি করেন। স্থানীয় নেতাদের অভিযোগ, অর্থের বিনিময়ে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে।
কক্সবাজার জেলার ১৮টি শাখা কমিটি গত ৭ অক্টোবর অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রদল। এসব কমিটিতে টাকার বিনিময়ে ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে বিবাহিত, ইয়াবা কারবারি, অছাত্র ও আন্দোলন-সংগ্রামে ভূমিকাহীন লোকজনকে আনা হয়েছে বলে অভিযোগ পদবঞ্চিতদের।
অছাত্র, বহিরাগত ও বিবাহিতদের দিয়ে সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার তিনটি ইউনিটের ছাত্রদলের কমিটি গঠনে মোটা অঙ্কের আর্থিক লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ১১ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলন করে এমন অভিযোগ করেন দক্ষিণ সরকারি কলেজ ছাত্রদল নেতা কামিল আহমদ তালুকদার।
তৃণমূলে ছাত্রদলের কমিটি গঠনে নানা অনিয়ম সম্প্রতি খুলনা বিভাগে ছাত্রদলের জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের স্বাক্ষরসংবলিত চিঠির মাধ্যমে তারেক রহমানকে জানানো হয়েছে। সিলেট, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ বিভাগের সাংগঠনিক টিমের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় বেশ কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে এবং জেলা পর্যায়ে কমিটি গঠনের আশ্বাস দিয়ে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
নানা অভিযোগ প্রসঙ্গে ফজলুর রহমান খোকন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ছাত্রদলের থানা, পৌর ও কলেজ মিলে প্রায় সাড়ে ৫০০ কমিটি অনুমোদন দিয়েছি। দ্রুতই ১০১ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি করা হবে। অনিয়ম ও আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ সত্য হলে তো ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেন।’
সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন শ্যামলের বক্তব্য জানতে চিঠি দেওয়া হলেও তিনি জবাব দেননি। পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি দম্ভোক্তি করেন, ‘এসব নিয়ে লিখে আমার কিছু করতে পারবেন না।’
ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু ও সাধারণ সম্পাদক আমিরুল ইসলাম আলীম বলেন, বৃহত্তর সংগঠন হিসেবে ছাত্রদলে অনেক সুযোগ্য নেতৃত্ব রয়েছে। এই নেতৃত্ব বাছাই করাটা খুব কঠিন। গতিশীলভাবে কাজ করতে গেলে ভুল হতে পারে। জেলা, সাংগঠনিক টিম ও কেন্দ্রের সমন্বয়ে কমিটি হচ্ছে। তার পরও অভিযোগ এলে তদন্তসাপেক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।
ছাত্রদলের সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি বজলুল করিম চৌধুরী আবেদ বলেন, ‘আমাদের সময়ও এমন বেশ কিছু অভিযোগ আসে। আমরা সঙ্গে সঙ্গেই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছি।’