রাজশাহীর আবাসিক হোটেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র-ছাত্রী খুনের রহস্য উদঘাটিত

SHARE

4ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ বিডি ডট কম,রাজশাহী প্রতিনিধি,২৮ অক্টোবর :  দীর্ঘ দেড় বছর পর রাজশাহীর আবাসিক হোটেল নাইস ইণ্টারন্যাশনালে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র-ছাত্রী খুনের রহস্য উদঘাটিত হয়েছে। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে প্রতিশোধ নিতেই চার বন্ধু মিলে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। ছাত্রীটিকে খুন করার আগে তাকে ধর্ষণ করা হয়।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এ ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে চারজনকে গ্রেফতার করেছে। পরে তাদের দেয়া স্বীকারোক্তি ও তথ্যের ভিত্তিতে এ রহস্য উদঘাটনে সক্ষম হয় পিবিআই।

গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে দু’জন রাজশাহী মহানগর হাকিম আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা স্বীকার করেছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পিবিআই’র এসআই মহিদুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

এসআই মহিদুল ইসলাম জানান, পুলিশের খাতায় শেষ হওয়া মামলার ছায়া তদন্ত করে পিবিআই। তাদের তদন্তে বের হয়ে আসে এই জোড়া খুনের লোমহর্ষক তথ্য।

ঝুলন্ত লাশের হাত বাঁধা ও রুমের মধ্যে একাধিক ব্র্যান্ডের সিগারেটের শেষ অংশ তাদের মনে সন্দেহ সৃষ্টি করে। এ সন্দেহ থেকে তারা তদন্ত শুরু করেন। এ ঘটনার সাথে ওই চারজন ছাড়াও আরো কেউ জড়িত আছে কি না সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

উল্লেখ্য, গত বছরের ২২ এপ্রিল রাজশাহীর আবাসিক হোটেল নাইস ইন্টারন্যাশনালের একটি কক্ষ থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মিজানুর রহমান মিজান ও পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী সুমাইয়া নাসরিনের লাশ উদ্ধার করা হয়। মিজানুরের লাশ ওড়না দিয়ে ফ্যানের সাথে ঝুলানো ছিল। সুমাইয়ার লাশ বিছানায় পড়েছিল।

ঘটনার পর দিন ২২ এপ্রিল সুমাইয়ার বাবা আব্দুল করিম বাদী হয়ে নগরীর বোয়ালিয়া থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। এতে হোটেলের কর্মচারীদের সহযোগিতায় তরুণীকে ধর্ষণসহ দু’জনকে হত্যার অভিযোগ করা হয়।

নগরীর বোয়ালিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সেলিম বাদশা মামলাটি তদন্ত শেষে সুমাইয়াকে ধর্ষণের পর হত্যা করে মিজানুর নিজেও আত্মহত্যা করেন বলে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন। কিন্তু এ প্রতিবেদনে সুমাইয়ার বাবা আব্দুল করিম আপত্তি তোলেন।

গ্রেফতারকৃত চারজন হলেন, রাজশাহী নগরীর বরেন্দ্র কলেজের ছাত্র আহসান হাবিব ওরফে রনি (২০), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাহাত মাহমুদ, রাজশাহী কলেজের ছাত্র আল আমিন ও বোরহান কবির উৎস। তাদের মধ্যে রনি পাবনার ফরিদপুর উপজেলার এনামুল হক সরদারের ছেলে। রাহাতের বাড়ি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার খোর্দ্দ গজাইদ গ্রামে। তার বাবার নাম আমিরুল ইসলাম। আল আমিন রাজশাহীর পবা উপজেলার জয়কৃষ্ণপুর গ্রামের টিপু সুলতানের ছেলে এবং উৎস নাটোরের লালপুর উপজেলার উত্তর লালপুর গ্রামের শফিউল কালামের ছেলে।

পিবিআই’র তদন্ত কর্মকর্তা মহিদুল ইসলাম জানান, গ্রেফতার চারজনের মধ্যে রনি ও উৎস আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা স্বীকার করেছে। তবে রাহাত ও আল আমিনকে আবারো রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানান তিনি।

তিনি আরো জানান, আহসান হাবিব ওরফে রনি রাজশাহী নগরীর বরেন্দ্র কলেজের ছাত্র হলেও ঘটনার পর থেকে সে ঢাকায় অবস্থান করছিল। গত ১৮ অক্টোবর তাকে ঢাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। ঘটনার দিন নিহত মিজানুর ও রনির একটি ফোন কলের সূত্র ধরে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এর পরদিন তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাজশাহী নগরীর একটি ছাত্রাবাস ও সোনাদিঘী এলাকা থেকে রাহাত মাহমুদ, আল আমিন ও উৎসকে গ্রেফতার করা হয়।

২০ অক্টোবর তাদের আদালতে হাজির করা হলে রনি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। অপর তিনজনকে চার দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ২৩ অক্টোবর তাদের তিনজনকে আদালতে হাজির করা হলে উৎস ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে ধর্ষণ ও দু’জনকে হত্যার কথা স্বীকার করে। রাজশাহী মহানগর হাকিম জাহিদুল ইসলাম আসামি রনির এবং বিচারক কুদরাত-ই-খোদা আসামি উৎসের জবানবান্দি রেকর্ড করেন।

রনি স্বীকার করেন, হোটেল কক্ষে মিজানুরকে প্রথমে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে হত্যা করা হয়। এর পর তারা সমুাইয়াকে ধর্ষণ করে। পুলিশ কর্মকর্তার মেয়ে বলে ঘটনা ফাঁস হওয়ার ভয়ে তারা তাকেও মুখে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করে।

জবানবন্দিতে রনি আরো জানায়, রাহাত মাহমুদের সাথে প্রথমে সুমাইয়ার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। পরে মিজানুরের সাথে নতুন করে তার প্রেমের সম্পর্ক হয়। এ নিয়ে রাহাত তার ওপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য পরিকল্পনা করে। রাহাত নগরীর বিনোদপুরের একটি ছাত্রাবাসে থাকত। সেখানে সে রনিকে ডেকে নিয়ে তার পরিকল্পনার কথা জানায়। মিজানুরের সাথে প্রেমের সর্ম্পকের কথা শুনে রনি বলে, মিজানুরকে সে চেনে। সে ল্যাংড়া।

এরই মধ্যে মিজানুরের সাথে দেখা করার জন্য সুমাইয়া রাজশাহীতে আসে। মিজানুর তাকে নাটোরের বনপাড়া থেকে এগিয়ে নিয়ে আসে। মিজানুর সে সময় রনিকে ফোন করে জানতে চায় শহরের কোন হোটেলে উঠলে ভালো হয়। রনি তাকে হোটেল নাইস ইণ্টারন্যাশনালে উঠার পরামর্শ দেয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২১ এপ্রিল রাত ৮ থেকে ১০টার মধ্যে হোটেল কক্ষে তারা মিজানুর ও সুমাইয়াকে হত্যা করে।

আদালতে রনি বলেন, হোটেলের ওই কক্ষে ঢুকে তারা প্রথমে শুধু সুমাইয়াকে পায়। তারপর তারা মিজানুরকে ফোন করে ডাকার জন্য সুমাইয়াকে চাপ দেয়। পরে সুমাইয়া বাধ্য হয়ে মিজানুরকে ফোন করে ডেকে আনে।

জবানবন্দিতে উৎস বলে, পাশের ভবনে এসির উপর দিয়ে গিয়ে তারা জানালা দিয়ে সুমাইয়ার রুমে প্রবেশ করে। মিজানুর রুমে আসার পর তার সাথে রাহাতের কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে রাহাত টি টেবিলের পায়া খুলে মিজানুরের মাথায় আঘাত করে। এতে তার মাথা ফেটে রক্ত বের হয়ে যায়। এর পর সুমাইয়ার ওড়না দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে রাহাত ও রনি মিলে মিজানুরকে হত্যা করে। তার পর লাশ মেঝেতে রেখেই তারা সবাই সুমাইয়াকে ধর্ষণ করে। এসময় মেয়েটি শুধু কাঁদছিল।

ধর্ষণের পর রনি সুমাইয়াকে গলা টিপে হত্যার চেষ্টা করে। এতে ব্যর্থ হলে রাহাত ও রনি দু’জনে মিলে সুমাইয়ার মুখে বালিশ চেপে ধরে হত্যা করে। এরপর মিজানুরের লাশ রনি ও রাহাত ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দেয়। ঘটনার সময় রাহাত ও রনি একাধিক সিগারেট খায়। এরপর রনি দরজা দিয়ে এবং অন্যরা জানালা দিয়ে বের হয়ে যায় বলে জবানবন্দিতে উল্লেখ করা হয়।

এদিকে, প্রশ্ন উঠেছে, সিসি ক্যামেরার আওতাধীন অভিজাত ওই আবাসিক হোটেলটিতে ঢুকে খুনিরা কিভাবে খুন করে নিরাপদে বেরিয়ে গেল?

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মহিদুল ইসলাম বলছেন, সার্বিক বিষয় নিয়ে তদন্ত চলছে। চারজনকে গ্রেফতার এবং দু’জনের স্বীকারোক্তি মামলার তদন্ত কার্যক্রম অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। তবে এ মুহূর্তে এতটুকু বলা যায়, রাজশাহীর আবাসিক এই হোটেলটিতে দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্রী খুনের রহস্য উদঘাটিত হয়েছে।