ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ বিডি ডট কম,নিজস্ব প্রতিনিধি,১৭ আগস্ট : জাতির পিতার খুনিদের ক্ষমতায় বসিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছিল বলে অভিযোগ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আত্মস্বীকৃত খুনিরাই ছিল পরবর্তী শাসকদের প্রিয়পাত্র’। গতকাল বুধবার বিকেলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এ অভিযোগ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনিদের যারা পুরস্কৃত করেছিলেন, তাদের প্রতি কেন জাতির ঘৃণা থাকবে না? তারা কেন বাংলাদেশের মূল রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেবে? তাদেরকে ক্ষমতার আনার জন্য কেন বারবার ষড়যন্ত্র হবে?’
বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণ করে তার কন্যা বলেন, ১৫ আগস্টের কালরাতের বর্ণনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সেই বাড়িতে কেউ বেঁচে ছিল না। আমার মায়ের কী অপরাধ ছিল এখনো বুঝে উঠতে পারিনি। আমার ভাই মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল, জামালকে কেন হত্যা করা হয়েছে। ১০ বছরের রাসেলের কী দোষ ছিল? আমার একমাত্র চাচা আবু নাসেরকে হত্যা করেছে খুনিরা। আমার মেজো ফুফুর বাড়িতে আক্রমণ করেছে। সেখানে শেখ ফজলুল হক মনিকে হত্যা করেছে। আমার সেজো ফুফুর বাসায় আক্রমণ করেছে। আমার ফুফা আবদুর রব সেরনিয়াবাতকে হত্যা করেছে। গুলির আঘাতে আমার ফুফু পঙ্গু হয়ে বেঁচে ছিলেন। আমার ছোট ফুফুর বাড়িতেও গিয়ে ফুফাকে খুঁজেছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘খুনিরা পরিকল্পিতভাবে এই হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল। এই ষড়যন্ত্রে খুনি মোশতাক আর জিয়া ছিল জড়িত। একজন প্রেসিডেন্ট আরেকজন সেনাপ্রধান। তাদের সম্পর্ক কত ঘনিষ্ঠ ছিল, হত্যার পরপরই একজন প্রেসিডেন্ট হয়ে গেল আরেকজন সেনাপ্রধান।’
বঙ্গবন্ধু হত্যার পরবর্তী সময়ের বর্ণনা দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন খুনিদের দিয়ে রাজনৈতিক সংগঠন করেছিলেন। জিয়া কাউকে মন্ত্রী, কাউকে উপদেষ্টা করেছেন। এরশাদ খুনি রশিদকে দিয়ে ফ্রিডম পার্টি বানিয়ে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী করেছেন। খালেদা ১৫ ফেব্রুয়ারি খুনি রশিদ ও হুদাকে সাংসদ করে বিরোধী দলের আসনে বসিয়েছিলেন। যারা আত্মস্বীকৃত খুনি তারাই ছিল পরবর্তী শাসকদের প্রিয়।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যারা আজ কোনো হত্যা হলেই সোচ্চার হয় বিচারের জন্য, তারা তো এই কথা বলে না যারা জাতির পিতাকে হত্যা করেছে, শিশুকে হত্যা করেছে, তাদেরকে যারা পুনর্বাসন করেছিল তাদের বিচার হয়নি কেন।’
আবেগাপ্লুত কণ্ঠে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজ আমি ক্ষমতায়, আমার কাছে সবাই বিচার চায়। কিন্তু আমি তো স্বজন হারানোর বিচার চাইতে পারিনি। এমনকি আমাদের বিচার চাওয়ার অধিকারটুকুও কেড়ে নেয়া হয়েছিল।’
বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ঠেকাতে নানা ষড়যন্ত্র হয়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায় যেদিন ঘোষণা হবে সেদিন হরতাল ডেকেছিল বিএনপি। আমার প্রশ্ন কেন বিএনপি হরতাল দিয়েছিল এবং রায় ঘোষণায় বাধা দিয়েছিল যদি তারা অপরাধী না হয়।’ সব বাধা উপেক্ষা করে রায় ঘোষণা করায় বিচারককে সাধুবাদ জানান বঙ্গবন্ধু কন্যা।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে খুনিরা ভেবেছিল স্বাধীনতার ইতিহাস মুছে ফেলবে, দেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র বানাবে। স্বাধীন জাতি হিসেবে দাঁড়াতে দেবে না। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। আমরা ২০০৮ সালে ক্ষমতায় এসে আবার দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।’
এই অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করার নানা চক্রান্ত হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০১৩ সালের ৫ মে’র কথা আপনাদের স্মরণ আছে। সেদিন ঢাকায় যে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছিল হেফাজতের নামে সেটা ছিল বিএনপি-জামায়াতের কাজ।’ তিনি বলেন, ‘তারা আবার ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি এমন ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল নির্বাচন ঠেকানোর নামে। একই কাজ করেছে ২০১৫ সালের তিন মাস।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ যখনই একটু সুন্দর স্বপ্ন দেখতে শুরু করে তখনই বারবার আঘাত আসে। তাদের দোসর আমাদের কিছু মানুষ যারা নিজেদেরকে জ্ঞানী-গুণী ভাবে। এটা কেন? এদেশের মানুষের কি বেঁচে থাকার অধিকার নেই। তাদের কি সুন্দরভাবে, উন্নত জীবন পাওয়ার অধিকার নেই?’
আক্ষেপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের দুর্ভাগ্য, এদেশের কল্যাণে যিনি কাজ করেন তাকে এর চরম খেসারত দিতে হয়।’ একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ যখন ধীরে ধীরে উন্নত দেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তখনই ১৫ আগস্টের আঘাত আসে বলে জানান তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই দেশে জাতির পিতার নামটা মুছে ফেলার অনেক চক্রান্ত হয়েছে। ২১ বছর তার ভাষণ প্রচার হয়নি। রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ছিলেন নিষিদ্ধ। মনগড়া ইতিহাস প্রচার করা হতো।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল বাংলাদেশে মনে হতো মুক্তিযুদ্ধ করাটাই ছিল অপরাধ। দেশটাকে যেন আবার পাকিস্তানের প্রদেশ হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা ছিল। অতি সূক্ষ্মভাবে জাতির পিতার ওপর অপবাদ দেয়া হয়েছে। যারা ২৭ মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তানের চাকরি করেছে তাদেরকে স্বাধীনতার ঘোষক প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা হয়েছে।’
আওয়ামী লীগের সভাপতি বলেন, ‘শুধু একজন রাষ্ট্রপতিকে হত্যা নয়, শুধু একটি দলের প্রধানকে নয়, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ধ্বংস করা, স্বাধীনতাকে খর্ব করা।’
এসময় আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পর্যবেক্ষণের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘অনেক কথা শুনি, সব কথার উত্তর দেয়া যায় না, সময় হলে সব কথার উত্তর দেব।’
সম্প্রতি সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে আপিল বিভাগ যে রায় দিয়েছে এর পর্যবেক্ষণের কিছু অংশে বঙ্গবন্ধুকে অবমাননা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। সেই দিকে ইঙ্গিত করে শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধে শুধু নেতৃত্বই দেননি, আওয়ামী লীগ সংগঠন গড়ে তুলেছেন। মন্ত্রিত্ব ছেড়েছেন এই সংগঠন গড়ে তুলছে। সারা দেশে ঘুরেছেন, মানুষকে মুক্তির পক্ষে সংগঠিত করেছেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এজন্য ২৫ মার্চ রাতে তাকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। এহিয়া খান তাকে দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসির রায়ও দেন। আর কাউকে তো ফাঁসির রায় দেননি। এতেই বোঝা যায় মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা কতটুকু।’
বিচারপতিদের দিকে ইঙ্গিত করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যারা এই কথা বলে যে কোনো একক ব্যক্তিত্বের দ্বারা দেশ স্বাধীন হয়নি তারা কি এহিয়া খানের ভাষণটা পড়েননি? সেই ভাষণটা পড়ে দেখুন কাকে দোষারোপ করা হয়েছে।’
আলোচনা সভায় সূচনা বক্তব্য দেন লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। যৌথভাবে সভা পরিচালনা দলের করেন প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ এবং উপ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন।
সভায় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিম, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য সিমিন হোসেন রিমি প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন- সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, আতাউর রহমান ও আবেদ খান। শোকাবহ ১৫ আগস্ট নিয়ে কবিতা আবৃত্তি করেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর।