রাজধানীতে সক্রিয় ‘রয়্যাল চিটিং গ্রুপ’র ৫ শতাধিক সদস্য

SHARE

cdewqওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ বিডি ডট কম,নিজস্ব প্রতিনিধি,১৫ জুন : রাজধানীর উত্তরার বাসিন্দা তানিয়া। ধামরাইয়ে তার ৪৭ শতাংশ জমি আছে। ব্যক্তিগত প্রয়োজনে তিনি ওই জমি বিক্রি করতে চান। মার্চের শেষদিকে লিটন, গাজী ও শরিফুল ইসলাম (প্রকৃত নাম নয়) এ জমি কেনার আগ্রহ প্রকাশ করে। তাদের সঙ্গে গুলশানের কিং সিটির ফাস্টফুডের দোকানে জমি কেনাবেচা সংক্রান্ত প্রাথমিক আলোচনা হয়। কাগজপত্র দেখার পর শরিফুল বলেন, ‘আমার ম্যাডাম আফরোজা মিমি জমিটি কিনবেন। ম্যাডামের সঙ্গে আলোচনা করে আপনাকে বিস্তারিত জানাব।’ মিমির পক্ষে জমি কিনতে শরিফুল ও অন্যরা তানিয়ার সঙ্গে আলোচনা এগিয়ে নিতে থাকে। কথিত ম্যাডাম আফরোজা মিমির সঙ্গে কথাও বলিয়ে দেয় তারা। বিশ্বস্ততা অর্জনের পর একদিন তানিয়াকে শরিফুল বলেন, ‘গাজীপুরের ডাইভারশন রোডে ছয়দানা মৌজায় জনৈক বারেকের ২৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ জমি আছে। এক কোটি ৬৫ লাখ টাকা হলেই জমিটি কেনা সম্ভব। আমরা দু’জন মিলে জমিটি কিনলে আমার ম্যাডামের কাছে দুই কোটি ৬৫ লাখ টাকায় বিক্রি করতে পারব। এতে যে লাভ হবে তার অর্ধেক আপনি আর অর্ধেক আমি নেব।’

শরিফুলের এ প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান তানিয়া। পরে তানিয়াকে শরিফুল বলেন, ‘বারেককে বায়না বাবদ অন্তত ৩২ লাখ টাকা দিতে হবে। আপনি ১৬ লাখ টাকা দেন। আমি ১৬ লাখ টাকা দিই। ১৫ দিনের মধ্যে বাকি টাকা পরিশোধ করলে বারেক জমি রেজিস্ট্রি করে দেবে।’ সে অনুযায়ী ৩ এপ্রিল খিলক্ষেত থানার নতুনবাজার খালপাড় ফুচকার দোকানে বসে শরিফুলের মাধ্যমে বারেককে তানিয়া ১৬ লাখ টাকা এবং ২২ লাখ টাকার একটি চেক তুলে দেন। পরদিন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সামনের রাস্তায় গাড়িতে বসে ১০ লাখ ৪১ হাজার টাকা দেন তানিয়া। এরপর থেকেই শরিফুল ও বারেক লাপাত্তা। তখনই তানিয়া বুঝতে পারেন, তিনি বড় ধরনের প্রতারণার ফাঁদে পড়েছেন। এ নিয়ে ২২ মে তানিয়া খিলক্ষেত থানায় একটি মামলা করেন।

পরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সিনিয়র সহকারী কমিশনার (এসি) আবু নাসের জনির নেতৃত্বে একটি দল অভিযান চালিয়ে এ চক্রের প্রধান শাহ আলমসহ ৭ সদস্যকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতার অন্যরা হল শাহাবুদ্দিন, শহিদুল ইসলাম ওরফে সোহেল, দেলোয়ার হোসেন, হুমায়ুন কবির, কাদের ও আরমান হোসেন। এরই মধ্যে তারা সবাই জামিন পেয়ে আবারও একই ধরনের প্রতারণায় মেতে উঠেছে। সম্প্রতি একজনের কাছ থেকে ২৮ লাখ ও অন্যজনের কাছ থেকে ১৭ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। পৃথক দুইটি অভিযোগের ভিত্তিতে এখন তাদের ধরতে হন্যে হয়ে খুঁজছে ডিবি। অভিনব কায়দায় এবং মোটা অঙ্কের প্রতারণা করে বলে এ ধরনের প্রতারণায় জড়িত গ্রুপ ডিবির কাছে রয়্যাল চিটিং ডিপার্টমেন্ট (আরসিডি) নামে পরিচিত। ডিবির দেয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে আরসিডির ৫ শতাধিক সদস্য সক্রিয় আছে। ঈদকে সামনে রেখে তারা হয়ে উঠছে বেপরোয়া। তাই ডিবির পক্ষ থেকে আরসিডি সদস্যদের একটি তালিকা করা হয়েছে। তাদের গ্রেফতার করতে এরই মধ্যে অভিযান শুরু হয়েছে। ডিবির সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।

ডিবি জানায়, আরসিডির সদস্যরা জমি, কঙ্কাল, কয়েন, মূর্তি, ম্যাগনেট পিলার, সাপের বিষ এবং তক্ষক বিকিকিনিসহ নানা কায়দায় প্রতারণা করে। তাছাড়া হ্যালো বিজনেজ, আমদানি-রফতানির ব্যবসা এবং মোবাইল ফোনে নামিদামি লোকের পরিচয়েও প্রতারণা করছে আরসিডির সদস্যরা। ডিবির তালিকায় আরসিডির যেসব সদস্যের নাম রয়েছে তাদের মধ্যে আছে মিরপুর ও শ্যামলী এলাকার হোসেন আলী মাতব্বর, মোয়াজ্জেম হোসেন এবং রফিকুল ইসলাম ওরফে রাজীব, উত্তরার জাহাঙ্গীর ওরফে ব্রিফকেস জাহাঙ্গীর, গুলশান-বনানীর শহীদ, মিরপুর ও মোহাম্মদপুর এলাকায় মহসিন, রামপুরা-বনশ্রী এলাকায় রহিম, উত্তরা-টঙ্গী-গাজীপুর এলাকায় জুয়েল, মোহাম্মদপুর এলাকায় নাসির, কয়েন প্রতারক নান্নু মিয়া, ম্যাগনেট প্রতারক দেবদাস মজুমদার, সাজিদুর রহমান সুজন এবং নাসিরুদ্দিন মুন্সি ওরফে অনোয়ার, পিলার প্রতারক আবদুন নুর, আনছার মিয়া, কদ্দুস মিয়া, আবদুল কাশেম, জবলু মিয়ার ছেলে মশাহিদ মিয়া, আহমদ মিয়া, শহিদ হাওলাদার, বাচ্চু খাঁ, আবদুস সালাম, জাহাঙ্গীর হোসেন এবং জহির আলী, মূর্তি প্রতারক আবদুর রহিম, আবদুল হালিম, শাহজাহান সিরাজ, নাজমুল হক, মনিন্দ্র চন্দ্র কামাল, রফিকুল ইসলাম, আবদুর রশিদ, আবদুর রহিম, সাপের বিষ প্রতারক আবু হানিফ ওরফে চেয়ারম্যান, আফছার আলী, নজরুল ইসলাম, মুক্তার হোসেন, রহিচ উদ্দিন, সোলায়মান আজাদ এবং তক্ষক প্রতারক ওয়াহিদুজ্জামান ও কামরুল ইসলাম।

সূত্র জানায়, সৌর প্যানেলের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি পরিচয়ে সৌরবিদ্যুৎ সরঞ্জাম ব্যবসায়ীদের সঙ্গে প্রতারণা করে রফিকুল। ঢাকার বাইরে থেকে প্রলোভন দেখিয়ে ভুক্তভোগীদের ঢাকায় ‘আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের’ অফিসে নিয়ে আসে সে। অত্যাধুনিক অফিসে বসে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভুক্তভোগীদের লাখ লাখ টাকার ব্যবসায়িক চুক্তি করায়। চুক্তি অনুযায়ী আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পরিচয় দেয়া ব্যক্তির হাতে চুক্তির টাকা তুলে দেন। এভাবে কিছুদিনের মধ্যে বেশকিছু ভুক্তভোগীর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়ার পর সাজানো ওই অফিস ছেড়ে পালিয়ে যায় প্রতারকরা।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমলে প্রচলিত তামা ও রুপার কয়েনের উচ্চমূল্যের কথা বলে আরসিডির সদস্যরা মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন। প্রতারকরা প্রচার করে, ১৭১৭, ১৭৯৯ ও ১৮১৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রচলিত ১ আনা, ২ আনার কয়েনগুলোয় রয়েছে তেজস্ক্রিয় উপাদান। এ কয়েন সঙ্গে থাকলে বজ্রপাত হলেও কেউ মারা যাবে না। এ অপপ্রচার চালিয়ে চক্রটি বৃত্তবান লোকদের সঙ্গে প্রতারণা চালাচ্ছে। কয়েন প্রতারণা করে নান্নু মিয়া নামের এক বক্তি এরই মধ্যে কোটিপতি বনে গেছে বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য এসেছে। ম্যাগনেট, কয়েন ও মূর্তি প্রতারকরা ম্যাগনেট পিলার, মূল্যবান কয়েন ও মূর্তি বিক্রি হবে বলে বিভিন্ন লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করে এ চক্রের সদস্যরা। যারা এসব লোভনীয় জিনিস কিনতে আগ্রহী হয়, তাদের একটি ঠিকানায় টাকা নিয়ে আসতে বলা হয়। এরপর প্রতারক চক্রের সদস্যরা ওইসব লোককে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে টাকা হাতিয়ে নেয়। পিলার, মূর্তি ও কয়েনের চুম্বক শক্তি দিয়ে যে কোনো ধাতব বস্তুকে মুহূর্তের মধ্যে স্বর্ণ বানানো যায় বলেও প্রচার করে চক্রটি।

ডিবির যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন জানান, সাপের বিষ কেনাবেচা- পুরোটাই একটা প্রতারণা। যারা এসব নিয়ে ব্যবসা করে তারা নিজেরাই ক্রেতা, নিজেরাই বিক্রেতা সাজে। তাদের তৎপরতা দেখে তৃতীয় পক্ষের কেউ লাভের আশায় কিনতে আসে। তখন তার কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়। তিনি জানান, সাপের বিষ ওষুধশিল্পে ব্যবহারের জন্য আমদানি করা হয়।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, একটি সরীসৃপ জাতীয় নিশাচর ও নিরীহ প্রাণী তক্ষক। প্রতারক চক্র বলে বেড়ায়, এ প্রাণী যার বাড়িতে থাকে তার সৌভাগ্য বয়ে আনে। নিঃসন্তানদের সন্তানাদি হয়। অনেকে বিশ্বাস করে, তক্ষক ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারে। এইচআইভি ও ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহার হয়। তাই একটি তক্ষকের মূল্য কোটি টাকা। প্রতারণা করে মানুষের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিতে আরসিডির সদস্যরা নানা গুজব রটিয়ে তক্ষক বেচাকেনা করছে। ডিবির সিনিয়র এসি আবু নাসের জনি জানান, হ্যালো বিজনেসের সদস্যরা কখনও উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, কখনও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোনো ইউনিটের প্রধান, কখনও মন্ত্রী-সচিব পরিচয়ে ফোন করে নানা কায়দায় টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিচ্ছে। চক্রের সদস্যরা কখনও বিকাশ সেন্টারের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে ফোন করে পাসওয়ার্ড পরিবর্তনসহ নানা অভিনব কায়দায় সাধারণ মানুষের অ্যাকাউন্ট থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা। ঈদকে সামনে রেখে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল তুহিন মোহাম্মদ মাসুদ জানান, এনএসআই ও র‌্যাব ডিজি পরিচয়ে রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের ফোন করে গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভয় দেখিয়ে চক্রের সদস্যরা মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আনোয়ার পাশা নামে এ চক্রের এক সদস্যকে ১ জুন গ্রেফতার করা হয়েছে।

সূত্র: যুগান্তর