ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ বিডি ডট কম.চট্টগ্রাম ব্যুরো,১৫ জুন : টানা বর্ষণে চট্টগ্রাম বিভাগের পাঁচ জেলায় পাহাড় ধসে ও পানিতে ডুবে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫২ জন।
গতকাল বুধবার পর্যন্ত কয়েক দিনের টানা বর্ষণের ফলে সৃষ্ট পাহাড় ধসে চট্টগ্রাম নগরী ও জেলায় নিহতের সংখ্যা ৩৪-এ উন্নীত হয়েছে বলে জানিয়েছে চট্টগ্রাম অফিস। এর মধ্যে জেলার রাঙ্গুনিয়া উপজেলাতেই ২৫ জনের লাশ উদ্ধারের কথা গতকাল নিশ্চিত করেছে জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোল রুম। একই উপজেলায় এখনো দুজন নিখোঁজ রয়েছে। নিহতদের মধ্যে চন্দনাইশে ৪ জন, রাউজানে ২ জন, বাঁশখালী, ফটিকছড়ি ও নগরীতে ১ জন।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হক চৌধুরী মায়া গতকাল রাঙ্গুনিয়ায় দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেন। তিনি নিখোঁজ ব্যক্তিদের উদ্ধার ও ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় যথাযথ ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। মন্ত্রী এরপর রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
রাঙ্গুনিয়ায় পাহাড় ধসে ১৬ জন, পাহাড়ি পানির ঢলে ৬ জন, চন্দনাইশে পাহাড় ধসে ৪ জন, রাউজানে পাহাড়ি পানির তোড়ে ১ জন এবং আকস্মিক টর্নেডোয় বাঁশখালীতে ঘরের দেয়াল ধসে ১ জন, চট্টগ্রাম মহানগরীর উত্তর হালিশহর ২৬নং ওয়ার্ডে ঘরের দেয়াল ধসে ১ জনসহ সর্বমোট ৩৪ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া, চন্দনাইশে দুইজন, উত্তর হালিশহরের ২৬নং ওয়ার্ডে দেয়াল ধসে পাঁচজন, বাঁশখালীতে দুইজনসহ মোট নয়জন আহত হয়েছেন এবং রাঙ্গুনিয়ায় নিখোঁজ চারজনের মধ্যে গতকাল আরো তিনজনের লাশ পাওয়া যায়।
রাঙ্গুনিয়া উপজেলার বিভিন্নস্থানে পাহাড় ধস এবং বন্যায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ জনে। নিখোঁজ রয়েছে ২ জন। আহত হয়েছে ৬২ জন। বন্যা কবলিত হয়েছে উপজেলার ৬ ইউনিয়নের অর্ধশত গ্রাম। উপজেলার উত্তরাঞ্চলে রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। প্রায় ২ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। চট্টগ্রাম কাপ্তাই মহাসড়কের বিক্ষিপ্ত এলাকায় পানি উঠেছে। উপজেলার উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে উপজেলা সদরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বন্যা কবলিত এলাকায় মানুষ চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় এখনও কোনো প্রকার সরকারি ত্রাণ সাহায্য পৌঁছানো হয়নি।
ফটিকছড়ি (চট্টগ্রাম) সংবাদদাতা জানান, রাতে পাহাড় ধসে ও পানিতে ডুবে এ পর্যন্ত তিনজনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। সেই সাথে ফটিকছড়ির এখনো ৬০ ভাগ এলাকা পানির নিচে। এতে কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে দুর্বিষহ দিন কাটাচ্ছে। এছাড়া উত্তর ফটিকছড়ির সাথে উপজেলা সদরের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ফটিকছড়ি-হেয়াকো সড়কের বেশ কিছু অংশ এখনো পানির নিচে থাকায় এবং বন্যায় উত্তর ফটিকছড়ির ফেনী-রামগড় সড়ক হেয়াকো এলাকায় ভেঙে যাওয়ায় উক্ত এলাকার মানুষ অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে।
রাঙ্গামাটি প্রতিনিধি জানান, রাঙ্গামাটি জেলায় পাহাড় ধসের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১০৫ জনে দাঁড়িয়েছে। রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোল রুম খেকে বুধবার সন্ধ্যায় এ তথ্য জানানো হয়। বুধবার দ্বিতীয় দিনে উদ্ধার কর্মীরা ১০টি মৃত দেহ উদ্ধার করে। এ সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। এর মধ্যে রাঙ্গামাটি শহরে ৪ সেনা সদস্যসহ ৫৮ জন, কাউখালী উপজেলায় ২৩ জন, কাপ্তাই উপজেলায় ১৮ জন, জুরাছড়ি উপজেলায় ৪ জন ও বিলাইছড়ি উপজেলায় ২ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে শিশু হচ্ছে ৩৩ জন, মহিলা ৩০ জন পুরুষ ৪২ জন। এর মধ্যে নিখোঁজ রয়েছে অন্তত ২০ জন। আহত হয়েছে ৮২ জন। প্রাথমিক চিকিত্সা নিয়ে বেশ কয়েকজন চলে গেলেও ৩৯ জন রাঙ্গামাটি সদর হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে।
বুধবার সকালে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের রাঙ্গামাটি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন। এর আগে তিনি সার্কিট হাউজে সাংবাদিকদের জানান, রাঙ্গামাটি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসন ও সহায়তায় সরকার সব রকম সহযোগিতা করবে।
তিনি ত্রাণ মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে তাত্ক্ষণিকভাবে রাঙ্গামাটির দুর্গত মানুষের জন্য ৫০ লক্ষ টাকা নগদ ১০০ মেট্রিক টন চাল, প্রত্যেককে টিন ও ৩ হাজার করে টাকা প্রদানের ঘোষণা দেন।
এসময় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহাবুবুল আলম হানিফ, আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও দুর্যোগ বিষয়ক সম্পাদক সুচিত্ কুমার নন্দী, সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক অসিম কুমার উকিল, চট্টগ্রাম এরিয়া কমান্ডার ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল জাহাঙ্গীর কবির তালুকদার উপস্থিত ছিলেন।
কাপ্তাই (রাঙ্গামাটি) সংবাদদাতা জানান, উপজেলার ৩৩টি স্থানে ছোটবড় পাহাড় ধস হয় বলে প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে। পাহাড় ধসের ফলে ১৩ জুন নারী পুরুষ শিশুসহ ১৮ জন নিহত হয়। ইকবাল নামক ১ যুবক কর্ণফুলী নদীতে পানির তোড়ে ভেসে যায়। গত ৪৮ ঘণ্টায়ও তার লাশ পাওয়া যায়নি। এদিকে পাহাড় ধসের ফলে কাপ্তাই ও রাঙ্গামাটি সড়কের বিভিন্ন স্থানে বড় আকারের ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। অনেক স্থানে রাস্তার বিরাট অংশ ভেঙে কর্ণফুলী নদীতে পড়েছে। ফলে কাপ্তাইয়ের সাথে চট্টগ্রাম ও রাঙ্গামাটির সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি জানান, জেলার লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার দুর্গম বর্মাছড়ি ইউনিয়নে পাহাড় ধসে এক নারীসহ ২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। গত ১৩ জুন মঙ্গলবার টানা বর্ষণে বর্মাছড়ি এলাকায় পাহাড় ধসে পড়লে এ দুর্ঘটনা ঘটে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এ খবর নিশ্চিত করেছেন। সাবেক লক্ষ্মীছড়ি ইউনয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাজেন্দ্র চাকমা এ প্রতিনিধিকে বলেন, বর্মাছড়ি ইউনিয়নের ফুত্যাছড়া পাড়ার প্রাণকৃত্য চাকমার ছেলে পরিমল চাকমা (৩০) পাহাড় ধসে মাটি চাপায় মৃত্যু হয়। একই পরিবারের শিশু ও নারীসহ আরো ৭ জন মারাত্মকভাবে আহত হয়।
এদিকে বর্মাছড়ি ও কাউখালী সীমান্তে হলুদ্যা পাড়া বড়ইতলী এলাকার পুতুল্যা চাকমার স্ত্রী কালেন্দ্রী চাকমা (৪৫) মাটি চাপায় মৃত্যু হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় পতুল্যা চাকমা আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। এব্যাপারে লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার জাহিদ ইকবাল পাহাড় ধসের ঘটনায় ২ জনের মৃত্যুর খবর শুনেছেন।
খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি জানান, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের রাজনৈতিক সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) গতকাল বুধবার এক বিবৃতিতে রাঙ্গামাটি, চট্টগ্রাম ও বান্দরবানসহ বিভিন্নস্থানে পাহাড় ধসে শতাধিক লোকের প্রাণহানি ও শতশত আহত হওয়ার ঘটনাকে স্মরণকালের ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় উল্লেখ করে গভীর শোক প্রকাশ করেছে। ইউপিডিএফ আজ বৃহস্পতিবার থেকে তিন পার্বত্য জেলায় তিন দিনব্যাপী শোক পালনের কর্মসূচি ঘোষণা দেন।
টেকনাফ (কক্সবাজার) সংবাদদাতা জানান, কক্সবাজারের টেকনাফে পাহাড় ধসে পিতা ও শিশু কন্যা মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। বুধবার রাত ২টায় টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং মডেল ইউনিয়নের পশ্চিম সাতঘরিয়াপাড়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। পাহাড় ধসে নিহতরা হলেন— আমির হোসেনের পুত্র মো. সেলিম (৪২) এবং তার শিশু কন্যা কিশোমণি (৩)। এদিকে পাহাড় ধসে নিহত পরিবারকে উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সংসদের পক্ষে নগদ নব্বই হাজার টাকা প্রদান করা হয়েছে।