ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),ঢাকা প্রতিনিধি, শুক্রবার ১৫ নভেম্বর ২০২৪ || অগ্রহায়ণ ১ ১৪৩১ :
পুরান ঢাকার দেবীদাস ঘাটের একটি আলোচিত বাড়ির নাম ‘দাদাবাড়ি ভবন’। রাজকীয় বাড়িটির ফটকে লেখা ‘চাঁন সরদার দাদাবাড়ি ভবন’। বাড়িটি যেন বিশেষ কোনো বাহিনীর সদর দপ্তর! বাড়িতে আলাদা ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক; ছিল বিশেষায়িত ড্রোন থেকে পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা। ছিল অস্ত্রাগার, শত শত ওয়াকিটকি আর টর্চার সেল এবং আয়নাঘর-সদৃশ গোপন কুঠুরি। ছিল মদের বারসহ নানা বিলাসী আয়োজন। ২০২০ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে বাড়ি থেকে ড্রোন, অবৈধ অস্ত্র, ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক সরঞ্জাম উদ্ধারের পর কিছুদিন বাড়িটি ঘিরে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ ছিল। হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিম জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর এবং হাজী সোলায়মান সংসদ সদস্য হওয়ার পর আগের অবস্থায় ফিরে যায় বহুল আলোচিত সেই দাদাবাড়ি ভবন। এরপর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর সেই বাড়ি থেকে অনেক কিছুই সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।
Advertisement
বাড়িটির মালিক পুরান ঢাকার আলোচিত ব্যবসায়ী হাজী সেলিম। তিনি অসুস্থ হওয়ার পর তার দুই ছেলে হাজী সোলায়মান ও ইরফান বাবার অবৈধ কারবারের নিয়ন্ত্রণ নেন। নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য সোলায়মান ও ইরফান বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন। সর্বশেষ বুধবার মধ্যরাতে চকবাজার থানা পুলিশ গুলশানের একটি ফ্ল্যাট থেকে সোলায়মান সেলিমকে গ্রেপ্তার করেছে। তাকে আদালতে হাজির করার পর পুলিশ তাকে জেলহাজতে পাঠায়।
পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার জসিম উদ্দিন বলেন, রোববার মধ্যরাতে চকবাজার থানার একটি মামলায় গুলশান এলাকায় অভিযান চালিয়ে সাবেক এমপি হাজী সোলায়মান সেলিমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে চকবাজার থানায় হত্যা মামলা রয়েছে। সোলায়মান সেলিমের বিরুদ্ধে হাজী সেলিমের অবৈধ দখল, চাঁদাবাজির সাম্রাজ্য রক্ষা, বিভিন্ন ব্যক্তিকে ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ রয়েছে। বিগত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ঢাকা-৭ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এমপি হওয়ার আগে ও পরে বিভিন্ন ব্যক্তিকে হুমকি ও হামলার অভিযোগ রয়েছে সোলায়মানের বিরুদ্ধে। পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, হাজী সেলিমের হয়ে বাদামতলী, চকবাজার, ইসলামপুর, চকমোঘলটুলী, বুড়িগঙ্গার বিভিন্ন ঘাটে চাঁদাবাজদের আলাদা গ্রুপ রয়েছে সোলায়মানের। ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে হাজি সেলিম ও তার লোকজন আত্মগোপনে চলে যান। এই সুযোগে হাজী সেলিমের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত মোশাররফ হোসেন ওরফে কালু হাজি পুরান ঢাকায় সেলিম নিয়ন্ত্রিত এলাকায় চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নেন। এখন হাজী সেলিম বাহিনীর হয়ে কালু এসব অপকর্ম করছেন।
২০২০ সালের ২৫ অক্টোবর ধানমন্ডিতে মারধরের অভিযোগে হাজী সেলিমের ছোট ছেলে ইরফান সেলিমের বিরুদ্ধে নৌবাহিনী কর্মকর্তা ওয়াসিফ আহম্মেদ খান থানায় মামলা করেন। মামলায় নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ও তার স্ত্রীকে ধাক্কা দিয়ে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ আনা হয় ইরফানের বিরুদ্ধে। ওই মামলার পর চকবাজারের দেবীদাস ঘাট লেনের ২৬ নম্বরে ‘চাঁন সর্দার দাদাবাড়ি’ ভবনে অভিযান চালায় র্যাব। অভিযান শেষে র্যাব জানায়, বহুল আলোচিত দাদাবাড়ি ভবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল ইরফান সেলিম ও সোলায়মান সেলিমের অপরাধ জগত। সেখান থেকেই নিয়ন্ত্রণ হতো পুরান ঢাকা। চলত যাবতীয় চাঁদাবাজি, অবৈধ দখল এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। পুরান ঢাকা নিয়ন্ত্রণের জন্য তৈরি করা হয়েছিল শক্তিশালী এক ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক। অভিযানে অবৈধ পিস্তল, বিধ্বংসী বন্দুক ও উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অবৈধ ড্রোন উদ্ধার করা হয়। ইরফান ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছিলেন। তিনি নোয়াখালীর সাবেক এক এমপির জামাতা।
Advertisement
ওই সময় র্যাব কর্মকর্তারা জানান, ওয়াকিটকির মাধ্যমে এক শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন ইরফান সেলিম ও সোলায়মান সেলিম। এর মাধ্যমে তারা এলাকা নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজি করতেন। সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাতেন। এসব ওয়াকিটকি মূলত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবহার করে থাকে। ওই সময় ইরফান সেলিমের একটি টর্চার সেল ও গোপন কুঠুরির সন্ধান মেলে। সেখানে তার প্রতিপক্ষ ও ব্যবসায়ীদের আটকে রেখে নির্যাতন করত তারা। বিভিন্ন জনের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করা হতো। সেখানে আরও পাওয়া গিয়েছিল হাতকড়া। যেগুলো সাধারণত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা ব্যবহার করেন।
বহুল আলোচিত ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ হাজী সেলিমকে নিয়ে রূপকথার মতো অনেক গল্প প্রচলিত আছে। তার বিরুদ্ধে দুদকে একাধিক মামলা ও অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে। দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নব্বইয়ের দশকে বিএনপি নেতা মীর শওকতের হাত ধরে রাজনীতিতে উত্থান হয় এক সময়ের পুরান ঢাকার লেবার সর্দার সেলিমের। ১৯৯৪ সালে তিনি বিএনপির সমর্থন নিয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৬৫ ও ৬৬ নম্বর ওয়ার্ডে গরুর গাড়ি প্রতীক নিয়ে কমিশনার (কাউন্সিলর) নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে বিএনপির মনোনয়ন চেয়েছিলেন তিনি। বিএনপির টিকিট না পেয়ে যোগ দেন আওয়ামী লীগে। দল থেকে পেয়েও যান সংসদ নির্বাচনের কাঙ্ক্ষিত টিকিট। লালবাগ, হাজারীবাগ ও কামরাঙ্গীরচর থানা নিয়ে গঠিত আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন তিনি। ক্ষমতার মসনদে বসে সম্পদের পাহাড় গড়েন তিনি। গড়ে তোলেন মদিনা গ্রুপসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ১৯৯৯ সালের মধ্যেই হাজী সেলিমের মদিনা গ্রুপের বার্ষিক টার্নওভার ৬০০ কোটি টাকার বেশি হয়। পরের অর্থবছরগুলোতে এ সংখ্যা শুধুই বাড়তে থাকে। ১৯৯৬-পরবর্তী সময়ে হাজী সেলিম জনপ্রতিনিধি হিসেবে নিজ এলাকার মহল্লাগুলোতে পঞ্চায়েত চালু করেন। বিভিন্ন বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য সাধারণ মানুষ তার কাছে যেতেন। জমি বা বাড়ি সংক্রান্ত বিরোধ নিয়ে তার কাছে গেলে সেগুলো নামমাত্র মূল্যে কিনে দখল করে নিতেন। ক্যাডার বাহিনী দিয়ে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করে তিনি বিভিন্ন ব্যক্তির ঘরে বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলিয়ে দিতেন। ওই কারণে তিনি ‘তালা হাজী’ নামেও পরিচিতি পান। চাঁদনীঘাটে ওয়াসার পানির পাম্পের জমি দখল করে সেখানে পেট্রোল পাম্প বসান সেলিম। সোয়ারীঘাটে নদীতীর দখল করে স্থাপন করেন চাঁদ সরদার কোল্ডস্টোরেজ। নবাববাড়ী এলাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস দখল করে সেখানে গুলশান আরা প্লাজা নামে বিশাল ভবন নির্মাণ করেন। আরমানিটোলা এলাকায় এক নারীর সম্পত্তি দখল করে তৈরি করেন এমটিসি টাওয়ার। নলগোলায় ভাওয়াল এস্টেটের জমি দখল করে নির্মাণ করেন ভবন। চকবাজারের ফ্রেন্ডশিপ মার্কেট ও জেলখানার পাশে ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ করে সেখানে মদিনা আশিক টাওয়ার এবং হাজী সেলিম টাওয়ার নামে দুটি বহুতল শপিংমল তৈরি করেন। দখলের সময় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের নতুন দোকান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও কাউকেই তিনি দোকান দেননি। জানা যায়, দোকান না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দুই ব্যবসায়ী আত্মহত্যা করেছিলেন।
এভাবেই হাজী সেলিম রাজধানীর পুরান ঢাকার বাদামতলী, নবাববাড়ী, আরমানিটোলা, মিটফোর্ড রোড, নবাবপুর রোড, ইমামগঞ্জ, ইসলামপুর, লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ, ধানমন্ডি, গুলশান, নারায়ণগঞ্জের পাগলা, ফতুল্লা এলাকায় বিপুল স্থাবর সম্পত্তির মালিক হয়েছেন।
২০০৮ সালের এপ্রিলে ২৭ কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের জন্য ১৩ বছরের জেল হয় সেলিমের। আর সেই সম্পদ নিজের কাছে রাখার জন্য তিন বছরের সাজা হয় তার স্ত্রী গুলশান আরার।
Advertisement
পুরান ঢাকার এক ব্যবসায়ী বলেন, যেখানেই চোখ পড়ত হাজী সেলিমের, সেটাই দখল করে নিতেন তিনি। তার হাত থেকে রেহাই পায়নি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন কিংবা কারাগারের জমিও। দখল করেন নবাব এস্টেটের বহু সম্পত্তি। হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করে ঢাকার প্রথম বাণিজ্যিক বিল্ডিং হিসেবে পরিচিত চকবাজারের ‘জাহাজবাড়ি’ ভবন গুঁড়িয়ে দেন হাজী সেলিম। ক্ষমতাধর হওয়ার কারণে হাজী সেলিম ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে কেউ থানায় অভিযোগ করতে পারেনি। রাজনৈতিক ক্ষমতা ও পেশিশক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজের সম্পদ বাড়িয়েছেন হাজার গুণ। রাজধানী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলায় নামে-বেনামে হাজী সেলিম ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে বহু বাড়ি ও ফ্ল্যাট এবং বেনামি সম্পদ রয়েছে। এ ছাড়া পটুয়াখালীতে পায়রা বন্দর-সংলগ্ন এলাকায় প্রচুর সম্পত্তি কিনেছেন তিনি। হাজী সেলিম গত ১ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। তার বিরুদ্ধে দুদক নতুন করে অনুসন্ধান শুরু করেছে। বুধবার রাতে গুলশানের বাসা থেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন হাজী সোলায়মান।
‘দাদাবাড়ি’ ভবন থেকে নিয়ন্ত্রণ হয় পুরান ঢাকা