অপকর্ম-দুর্নীতিতে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন হেনরী (ভিডিও)

SHARE

য়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি, শনিবার   ১২ অক্টোবর ২০২৪ ||  আশ্বিন ২৭ ১৪৩১ :

গৃহবধূ, সংগীতশিল্পী ও স্কুলশিক্ষিকা থেকে রাজনীতিতে নাম লেখান। ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হলেও জয়ী হতে পারেননি। অবশ্য সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদ পেয়ে যান সিরাজগঞ্জের প্রভাবশালী নেত্রী জান্নাত আরা হেনরী। এই পদই তার কাছে হয়ে ওঠে আলাদীনের প্রদীপ। অপকর্ম আর দুর্নীতির মাধ্যমে অঢেল সম্পদের মালিক বনে যান। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বনে যান সিরাজগঞ্জের একচ্ছত্র অধিপতি। নিজে সংসদ সদস্য হওয়ার তিন মাসের মধ্যে অর্থ ঢেলে স্বামী শামীম তালুকদারকে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বানিয়ে আনেন। দুর্নীতি, অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সংস্রবে ১৬ বছরে ৫০০ কোটি টাকারও বেশি সম্পদের মালিক হয়েছেন। অথচ ২০০৮ সালে মাত্র সাড়ে ৬ লাখ টাকার সম্পদের মালিক ছিলেন তিনি। সরকারি হিসাবেই তার সম্পদ বেড়েছে ৮৮৪ গুণ, বেসরকারি হিসেবে যা ২১শ গুণেরও বেশি।

Advertisement

সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার সয়দাবাদ ইউনিয়নের সদানন্দপুর গ্রামের আব্দুল হামিদ মিঞার মেয়ে জান্নাত আরা হেনরী। জেলার সর্বজন শ্রদ্ধেয় রাজনীতিবিদ ভাষাসৈনিক সাবেক গভর্নর মরহুম মোতাহার হোসেন তালুকদারের ছেলে শামীম তালুকদার লাবুর সঙ্গে বিয়ের পর সবুজ কানন উচ্চ বিদ্যালয়ে সংগীত শিক্ষকের চাকরি নেন। পাশাপাশি রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী হিসেবে জেলার সাংস্কৃতিক কর্মকা-েও নিজেকে সম্পৃক্ত করেন।

রাজনৈতিক পরিবারের পুত্রবধূ হওয়ার সুবাদে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন মহিলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। একপর্যায়ে কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিরাজগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন যুদ্ধে তৃণমূল ভোটে অংশগ্রহণ করে দ্বিতীয় হন। প্রথম হয়েছিলেন দলের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম। দুর্নীতির মামলায় তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে না পারায় ভাগ্যের চাকা খুলে যায় হেনরীর। নৌকা প্রতীকে পান রাজনীতিতে সম্পূর্ণ আনাড়ি এ গৃহবধূ। ওই নির্বাচনে সারাদেশে আওয়ামী লীগের জয়জয়কার হলেও অল্প ভোটের ব্যবধানে হেরে যান হেনরী। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার

নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠন করার পর জান্নাত আরা হেনরীকে করা হয় সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য।

এর পর আর তাকে পেছনে তাকাতে হয়নি। এক লাফে উঠে যান ৮৭ লাখ টাকার ল্যান্ড ক্লুজারে। ঢাকা ও সিরাজগঞ্জ মিলে গড়ে তোলেন কয়েকটি বাড়ি ও একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। মাত্র সাড়ে তিন বছরেই তিনি শতকোটি টাকার মালিক বনে যান। আলোচিত হলমার্ক কেলেঙ্কারির মামলায় জড়িয়ে পড়েন তিনি। এ ঘটনায় পরিচালনা পর্ষদের কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। অবশ্য ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ওই অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি পান হেনরীসহ পরিচালকরা।

হলমার্ক কেলেঙ্কারি থেকে দায়মুক্তির পর ধীরে ধীরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও সম্পত্তি বাড়াতে থাকেন। নিজের নামে ছাড়াও স্বামী শামীম তালুকদার লাবু, মেয়ে ও বোনের নামে গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড়। দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চেষ্টা করেও দলীয় মনোনয়ন পেতে ব্যর্থ হন তিনি।

জাতীয় নির্বাচনের আগে একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা জানান, ২০২৩ সালে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর রাজনীতিতে তার প্রভাব ক্রমশই বাড়তে থাকে। অবশেষে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন বাগিয়ে এনে প্রথমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হন। নিজে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার তিন মাসের মাথায় স্বামী শামীম তালুকদার লাবুকে কোটি কোটি টাকা খরচ করে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত করে আনেন।

Advertisement

এমপি হওয়ার সুবাদে সিরাজগঞ্জ ও গাজীপুরে হেনরীর নামে সাইনবোর্ড দেওয়া স্থাবর অনেক সম্পদ আছে। সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার নলিছাপাড়া নামক স্থানে হেনরী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কলেজ, পাশেই হেনরী ইনস্টিটিউট অব বায়োসায়েন্স টেকনোলজি, শহরের মুজিব সড়কে একটি দ্বিতল বাসভবন, পাশে আরেকটি ৬ তলা বিলাসবহুল বাড়ি। ওই বাড়ির বিপরীত পাশে ৯ তলা ভবনে রয়েছে অর্ধকোটি টাকা মূল্যের একটি ফ্ল্যাট, শহরের ফজল খান রোডে হেনরী স্কলাসটিকা স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সদর উপজেলার রতনকান্দি ইউনিয়নের গজারিয়াতে ‘হেনরী ভুবন’ নামে আধুনিকমানের বিশাল বৃদ্ধাশ্রম, তার বিপরীত পাশে ‘কিছুক্ষণ’ নামে একটি রিসোর্ট, রিসোর্টের পশ্চিম পাশে অপটিক ফাইবার কারখানা, তার পাশে গড়ে উঠেছে গরুর খামার, উত্তর পাশে শ্বশুর মোতাহার হোসেন তালুকদারের নামে হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল, শহরের এসএস রোডে বোন জুবিলীর নামে ছয়তলা বাণিজ্যিক ভবন, সয়দাবাদ ইউনিয়নের সদানন্দপুরে পাঁচতলা আবাসিক ভবন, কড্ডায় নির্মাণাধীন রয়েছে পেট্রলপাম্প, শহরের সদর পোস্ট অফিসের বিপরীতে নির্মিত হচ্ছে একটি বহুতল ভবন। এ ছাড়া গাজীপুরের শ্রীপুরে বিলাসবহুল ‘রাস রিসোর্ট’ প্রতিষ্ঠা করেছেন। ১৪টি আধুনিক কক্ষ, পাঁচটি প্রিমিয়াম বাংলো, আলাদা জায়গায় চারটি আর্কিটেকচারাল ডিলাক্স কটেজ ও আধুনিক সুইমিংপুল রয়েছে। শুধু তাই না, সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার কিছু দিন পর শিয়ালকোল ইউনিয়নের শিলন্দা গ্রামে ১০.১২ বিঘা অকৃষিজমি প্রায় সাড়ে ১১ কোটি টাকায় কিনেছেন হেনরী। সিরাজগঞ্জ, ঢাকা ও গাজীপুরে প্রায় সাড়ে ১৮শ শতাংশ কৃষি ও অকৃষিজমি রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে ৯টি বিলাসবহুল গাড়ি। এর মধ্যে ৯৫ লাখ টাকা মূল্যের একটি প্রাডো জিপ, ১৮ ও ২৬ লাখ টাকা মূল্যের দুটি প্রাইভেটকার, ১২ লাখ টাকা মূল্যের একটি পিকআপ। আরও রয়েছে ৫টি মাইক্রোবাস। ৯টি গাড়ি, যার মূল্য দেখানো প্রায় ২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।

২০০৮ সালের নির্বাচনী হলফনামা অনুযায়ী, জান্নাত আরা হেনরীর বার্ষিক আয় দেখানো হয় এক লাখ ২২ হাজার টাকা। সেই সময় সম্পদ দেখানো হয়েছিল প্রায় ৬ লাখ ৩৪ হাজার ৫০০ টাকার। গত ১৬ বছরে ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম, দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি ৫০০ কোটি টাকার মালিক বনেছেন।

এদিকে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই পলাতক থাকেন জান্নাত আরা হেনরী ও তার স্বামী শামীম তালুকদার লাবু। দীর্ঘ প্রায় দুই মাস পর গত সোমবার মৌলভীবাজার থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

Advertisement

এ বিষয়ে সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান বাচ্চু দেশের বাইরে থাকায় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশিদ খান হাসান জানান, সাবেক এমপি হেনরী এবং তার স্বামী সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শামীম তালুকদার লাবু রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে অর্থ লোপাট করেছেন। আন্দোলনে যুবদল ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের গুলি ও কুপিয়ে হত্যার বিচারসহ হলমার্ক কেলেঙ্কারির সহযোগী হেনরীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেখতে চায় সিরাজগঞ্জবাসী। বিএনপির পক্ষ থেকেও এসব লুটেরার বিচার দ্রুত নিষ্পত্তির মাধ্যমে সাজা দেখতে চাই।

জান্নাত আরা হেনরী। পুরোনো ছবি