এখন নারীরা নির্বিঘ্নে সমুদ্র তলদেশ ঘুরে দেখেন। অথচ রান্নামারি দানবের সময় রাস্তায় বের হতেও ভয় পেতেন। ছবি : সংগৃহীত
ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি,শুক্রবার, ২৯ এপ্রিল ২০২২ : আমাদের দেশের মায়েরা যেমন সন্তানকে ঘুম পাড়াতে ভূতের ভয় দেখান তেমনি দেখান মালদ্বীপের মায়েরাও। তবে সেখানকার মায়েরা সন্তানদের ঘুম পাড়ান রান্নামারি দানবের ভয় দেখিয়ে।
মালদ্বীপের উপকথা অনুযায়ী, রান্নামারি হচ্ছে এক সামুদ্রিক দানব। আজ থেকে প্রায় এক হাজার বছর আগে এই দানবের উৎপাত শুরু হয়। তখন প্রতিদিন রাতের বেলা এই দানব সমুদ্রের তলদেশ থেকে উঠে এসে মালদ্বীপের রাজধানী মালের লোকালয়ে পা রাখত। এরপর চলত তার ধ্বংসযজ্ঞ।
এই দানবের মূল কাজ ছিল লোকালয়ের যত কুমারী নারী রয়েছে, তাদের হত্যা করা। মাসের পর মাস এই দানবের আক্রমণে মালদ্বীপের সমাজে নারীদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমতে শুরু করে। বিষয়টি নিয়ে মালদ্বীপের তৎকালীন রাজা চিন্তায় পড়ে যান। সবার সঙ্গে পরামর্শের পর রাজা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, রাজধানী মালে থেকে কাছে সমুদ্রতীরে একটি মন্দির তৈরি করা হবে। ওই মন্দিরের ভেতরে প্রতি দুই সপ্তাহ পর পর একজন কুমারী নারীকে রেখে আসা হবে।
এরকম করার কারণ ছিল, রান্নামারি দানব অন্যান্য সময় অসংখ্য কুমারী নারী হত্যা করত, কিন্তু এবার যদি মাত্র একজন নারীতেই সে সন্তুষ্ট থাকে, তাহলে সেটাই ভালো। তার এই পরিকল্পনা কাজে দিয়েছিল, রান্নামারি দানব প্রতি দুই সপ্তাহ পর পর সেই মন্দিরের ভেতর প্রবেশ করে আগে থেকেই রেখে আসা সেই নারীকে হত্যা করতে, লোকালয়ের দিকে আর নজর দিত না।
সাধারণত যে কুমারী নারীকে মন্দিরে রেখে আসা হবে, তাকে রাতের বেলা একেবারে সাজিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো মন্দিরের কাছে। এরপর মন্দিরের ভেতরে তাকে শক্ত করে বেঁধে রেখে আসা হতো। পরদিন ভোরবেলা গিয়ে সেই কুমারী নারীর পরিবারের সদস্যরা গিয়ে তার প্রাণহীন দেহ বহন করে নিয়ে আসত, এবং সৎকারের আয়োজন করত। এই পরিবারগুলো সমাজে বিশেষ মর্যাদা লাভ করত।
এভাবেই চলছিল দিনকাল। কিন্তু ১২০০ সালের দিকে আবুল বারাকাত নামে এক মরক্কান পর্যটক, যিনি মালদ্বীপে ইসলাম প্রচার করতে এসেছিলেন, তিনি এই ঘটনা শুনে দারুণ বিস্মিত হন। তিনি এরপর প্রস্তাব করেন, কুমারী নারীর পরিবর্তে তিনি নিজে একরাত সেখানে কাটাবেন। মালদ্বীপের তৎকালীন রাজা তাকে প্রথমে বাধা দিলেও পরবর্তীতে তার জেদি মনোভাবের জন্য তার প্রস্তাব মেনে নিতে বাধ্য হন।
নিয়ম অনুযায়ী, তাকে রাতের বেলা মন্দিরের ভেতর রেখে আসা হয়। পর দিন যখন রাজার প্রতিনিধি সেই মরক্কান পর্যটকের মৃতদেহ আনার জন্য মন্দিরে প্রবেশ করে, তখন তিনি বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেন যে সেই মরক্কান পর্যটক কুরআন শরীফ থেকে বিভিন্ন আয়াত তেলাওয়াত করছেন। তাকে মালদ্বীপের রাজার দরবারে নিয়ে আসা তিনি।
রাজদরবারে সেই মরক্কান পর্যটক বলেছিলেন, যখন রান্নামারি দানব এসেছিল, তখন তিনি কুরআন শরীফের কিছু আয়াত পাঠ করেন। এরপর রান্নামারি দানব তাকে আক্রমণ না করে সমু্দ্রে ফিরে যায়। তিনি মালদ্বীপের তৎকালীন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাজা ও তার জনগণকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের আহ্বান জানান। তারা তার প্রস্তাবে সাড়া দেয়। সকলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। উপকথা অনুযায়ী, এভাবেই মালদ্বীপে ইসলামের আগমন ঘটে।
অনেকে আবার এই রান্নামারি দানব সম্পর্কে প্রচলিত আরেকটি উপকথার ভিন্ন সংস্করণ প্রচার করেন। তাদের প্রচার করা উপকথা অনুযায়ী, রান্নামারি বলতে কিছুই ছিল না, বরং মালদ্বীপের তৎকালীন রাজা ছিলেন একজন বিকৃত মস্তিষ্ক, ও চরম নারীলিপ্সু ব্যক্তি। রান্নামারি দানবের অন্তরালে তিনিই সেই মন্দিরে গিয়ে সারারাত ধরে কুমারী নারীদের ভোগ করতেন। এরপর তার ভোগকর্ম শেষ হলে গেলে অসহায় নারীটিকে হত্যা করতেন, যাতে পরবর্তীতে সে মুক্ত হয়ে কোনো ঝামেলা করতে না পারে। অর্থাৎ, ‘রান্নামারি’ দানব ছিল তার একটি বানানো গল্প, যার আড়ালে তিনি নিজে তার ব্যক্তিগত নারীলিপ্সা মেটাতেন।
পরবর্তীতে যখন সেই মরক্কান পর্যটক ইসলামের বার্তা নিয়ে হাজির হন, তখন তিনি নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত বোধ করেন। তবে রান্নামারি দানব সম্পর্কে প্রচলিত এই ভিন্ন সংস্করণের গল্পের প্রচারকেরা হলেন মালদ্বীপের শিক্ষিত সমাজের লোকজন।
প্রসঙ্গত, বেশিরভাগ উপকথার ক্ষেত্রেও যা হয়, রান্নামারি দানবের উপকথা সম্পর্কেও তা-ই হয়েছিল। মূলত উপকথাগুলোর নির্ভরযোগ্য সূত্র পাওয়া যায় না, অর্থাৎ উপকথায় যেসব গল্পের অবতারণা করা হয়, সেগুলো যে সত্যি, এরকমটা দাবি করা হয় না কখনোই।