ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ বিডি ডট কম,চট্টগ্রাম ব্যুরো,২৩ জুন : ২০১১ সালের ১১ জুলাই চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার আবু তোরাব সড়কের সৈদালী এলাকায় ট্রাক রাস্তার পাশের ডোবায় পড়ে ৪২ ছাত্রসহ ৪৪ জন নিহত হয়। একসঙ্গে এত শিশুর মৃত্যু সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে দেয়, রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হয় শোক দিবস।
গত ১৩ জুন সকালে চট্টগ্রামসহ চার জেলায় নেমে আসে ভয়াবহ দুর্যোগ। টানা বর্ষণ ও পাহাড় ধসে মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে পাঁচ জেলা পরিণত হয় মৃত্যু উপত্যকায়।
প্রশাসনের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, মাটিচাপায় ১৬০ জন নিহত হয়েছেন। তবে নিহতের তালিকায় চোখ রেখে দেখা যায় ছাড়িয়ে গেছে মিরসরাইয়ের ঘটনাকেও। পাহাড় কেড়ে নিয়েছে চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়িসহ পাঁচ জেলার ৩০ পরিবারের ৫২ শিশুর প্রাণ। শুধু তাই নয়, ১২ পরিবারে বেঁচে নেই কোনো শিশু।
পাহাড়ধসের ঘটনায় সব হারিয়ে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার দিনমজুর মফিজুর রহমান কোনোরকমে বেঁচে আছেন। প্রতিবেশীদের বাড়িতে ঠাঁই হলেও বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন মা, স্ত্রী আর তিন সন্তানের কথা মনে করে। স্ত্রী জোৎস্না বেগম ও মা রিজিয়া বেগমের সঙ্গে মাটিচাপায় নিহত হয়েছে তার তিন সন্তান মুনমুন (৭), সাজ্জাদ হোসেন হিরু (৯) ও মানিকুর রহমান (১১)।
চার মাস আগে আবুধাবী থেকে ফিরেছিলেন রাঙ্গুনিয়ার রাজানগর ইউনিয়নের বগারবিল পাউক্যাঘোনা এলাকার নজরুল ইসলাম। ছেলে মনজুর ইসলাম (১৫), মেয়ে সাথী (৭) ও লাকি আক্তারের (২৫) টানেই বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছিলেন তিনি। কিন্তু পাহাড়ধসে নজরুলের সঙ্গে তার স্ত্রী আসমা আক্তার এবং মনজুর ও সাথীর প্রাণ গেছে।
জুঁইমণি চাকমার বয়স ছিল ১৪। যতক্ষণ বাড়িতে থাকত ততক্ষণ তার আদরের ধন হয়ে থাকত ছোট বোন জুমজুমি (৬)। নোয়ারী পুলিশ লাইনে চাকরি করা সুভাষ বাসায় এলেই দুই সন্তানের নানা আবদার ও খুনসুটির ফিরিস্তি নিয়ে হাজির হতেন স্ত্রী রুপালী চাকমা। পাহাড়ধসের ঘটনায় তিনজনকেই হারিয়েছেন সুভাষ চাকমা।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. প্রণব কুমার চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে ঘন ঘন দুর্যোগ এলেও পাহাড়ধসে এত শিশুর মৃত্যু আগে হয়নি। ওই ঘটনায় অনেক শিশু আহত হয়ে হাসপাতালে আছে। যারা চিকিৎসা নিচ্ছেন তাদের বিষয়ে স্বজনদের খুব সতর্ক থাকতে হবে। তাদের খাবার, পুষ্টি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদির ব্যাপারে মনোযোগী হতে হবে। আর যে পরিবারে সব শিশু মারা গেছে তাদের স্বজনকেও বিশেষ যত্নে রাখতে হবে। বাবা-মা হারিয়ে যাওয়া শিশু সন্তানের স্মৃতি যদি বারবার স্মরণ করেন তবে তাদের মানসিক অবস্থার ওপরও চাপ তৈরি হবে।
পাহাড়ধসে রাঙামাটিতে নিহত হয়েছে ১১৮ জন। তার মধ্যে রাঙামাটি সদরে নিহত ৬৮ জনের ২৪ জনই শিশু। তারা ছিল ৯ পরিবারের সদস্য। রাঙামাটি সদর উপজেলায় একই পরিবারে যারা মারা গেছে তারা হলো- সোনালী চাকমার ছেলে অমিয় চাকমা (১০), ভেদভেদী সনাতনপাড়ার লিটন মলি্লক ও চুমকী মলি্লকের একমাত্র সন্তান আইয়ুশ মলি্লক (২), কাবুক্ক্যা বালুখালীর সীমা চাকমার দুই সন্তান সুজন চাকমা (৭) ও বন্যা চাকমা (৩), ভেদভেদী এলাকার মধুমিতা চাকমার মেয়ে জুরি চাকমা (১০), সুরভী বেগমের মেয়ে বৃষ্টি (১০), ভেদভেদী নতুনপাড়ার নবী হোসেনের মেয়ে রুনা আক্তার (১৫) ও সোহাগ (১৪), ভেদভেদী যুব উন্নয়ন বোর্ড এলাকার সুজিতা চাকমার ছেলে সৌম্য চাকমা (৫) এবং মনিপাড়ার কান্তি সোনা চাকমার মেয়ে শান্তনা চাকমা (৬)।
রাঙামাটিতে নিহত অন্য শিশুরা হলো- নাইমা আক্তার (৬), নুরী আক্তার (৩), ফেন্সী চাকমা (৪), প্রিয়তোষ চাকমা (১২), সুকেন চাকমা (১২), সূচনা চাকমা (১৪), তৃষা মণি চাকমা (১৬), জয়েস চাকমা (৯), সুস্মিতা চাকমা (৫), আজিজা আক্তার (৫), মো. মুজিবুর রহমান (১২) ও জিসান (২)। রাঙামাটির জুড়াছড়িতে নিহত ছয়জনের মধ্যে চারজন শিশু। তারা হলো- বিশ্বমণি চাকমা (১০), হ্যাপী তঞ্চঙ্গ্যা (৭), চিয়ং চাকমা (১৭) ও চিবে চোগা চাকমা (১৬)।
কাউখালীতে নিহত ২১ জনের মধ্যে ছয় পরিবারের পাঁচ শিশু রয়েছে। তারা হলো- উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের জুনুমাছড়া এলাকার অমর শান্তি চাকমার মেয়ে বৈশাখী চাকমা (৭), বাকছড়ি এলাকার ফুলমোহন চাকমা ও মণিমালা চাকমার মেয়ে বৃষ মণি চাকমা (১১), হাজাছড়ি গ্রামের কমলধন চাকমার ছেলে সোহেল চাকমা (৭), বেতবুনিয়া ইউনিয়নের রাউজান ঘোনা গ্রামের অংচিং মারমা ও আশেমা মারমা দম্পতির দুই সন্তান তেমা মারমা (১২) ও ছেলে ক্যাথোয়াইচিং মারমা (৭)।
কাপ্তাইয়ে নিহত ১৮ জনের মধ্যে শিশু রয়েছে সাতজন। তারা হলো- নোমান (৫), রমজান আলী (৫), নিতুই মার্মা (৬), রোহান (৭), আই প্রু মারমা (১৫), চিংমিউ মারমা (১৫) ও প্রানু চিং মারমা (৬)।
চট্টগ্রামের চন্দনাইশে নিহত চারজনের মধ্যে দু’জন শিশু। তারা হলো- তালাও ক্যায়াংয়ের শিশুপুত্র কেওছ্যা ক্যায়াং ও ক্যেলাও অং ক্যায়াংয়ের মেয়ে ম্যে ম্যাও ক্যায়াং (১২)। টেকনাফে ছলিমের সঙ্গে নিহত হয় তার মেয়ে তিসা মণি (১০)। বান্দরবানে পাহাড়চাপায় মারা গেছে আজিজুরের স্ত্রী ও সন্তান সুফিয়া (১০)। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় দিনমজুর ইসমাইল ও মনিরা আক্তারের দুই সন্তান ইভা (৮) ও ইছা (৪) নিহত হয়েছে এক রাতেই। ইসলামপুরের মইন্যারটেক এলাকার বাসিন্দা মো. সেলিমের নাতনি জোসনা, শাহানু ও ফালুমাও নিহত হয়েছে।
রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মানজারুল মান্নান বলেন, প্রতিটি মৃত্যুই কষ্টের। তবে শিশুদের মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। তারা মা-বাবা ও ঘরকে সবচেয়ে আপন মনে করে। কিন্তু পাহাড়ের নির্মমতায় মা-বাবাও তাদের রক্ষা করতে পারেনি। কোনো কোনো পরিবারে শুধু বেঁচে আছেন মা কিংবা বাবা। শিশুদের কথা মনে করে আশ্রয়কেন্দ্রে তাদের অনেকেই মূর্ছা যাচ্ছেন। তাই আশ্রয়কেন্দ্রে সার্বক্ষণিক ডাক্তার রাখা হয়েছে।
বান্দরবানের জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বণিক বলেন, হারানো সন্তানের নানা স্মৃতি মনে করে বিলাপ করছেন তাদের বাবা-মা। আশ্রয়কেন্দ্রে এমন দৃশ্য দেখে আশপাশে থাকা অন্যরাও হয়ে পড়ছেন অশ্রুসিক্ত। সূত্র: সমকাল।